দুর্ভোগের সড়ক। জীর্ণ রাস্তায় কাদায় ফেঁসেছে গাড়ি। করিমগঞ্জে। ছবি: পিটিআই
শিলচরে পরিবেশ দিবস সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়েই রাস্তা নির্মাণের দাবি উঠল শিলচরে। কোন বন্যপ্রাণীর কথা ভেবে ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরের কাজ আটকে রাখা হয়েছে, বনকর্তার কাছে তা জানতে চাইলেন স্থানীয় ইঞ্জিনিয়াররা। হতবাক হয়েই কার্যত মাইক্রোফোন ছাড়েন অতিথি বক্তা কাছাড় জেলার বনবিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর তেজস মরিস্বামী।
প্রতি বছরের মতো এ বারও পরিবেশ দিবস উপলক্ষে আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স (ইন্ডিয়া)-র শিলচর লোকাল সেন্টার। নির্ধারিত বিষয় ছিল— বন্যপ্রাণী নিয়ে অবৈধ ব্যবসা। সেন্টার চেয়ারম্যান ডি পি রায় স্বাগত ভাষণ দেন। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক পান্না দে নানা তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘‘সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বন্যপ্রাণীদের নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে। গত ৪০ বছরে বিশ্বে ৫০ শতাংশ প্রাণী-প্রজাতি হ্রাস পেয়েছে। অবৈধ ব্যবসার মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বন্যপ্রাণী পাচার।
অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর তেজস মরিস্বামীও এ নিয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘‘বন্যপ্রাণী কমে যাওয়ায় খাদ্যশৃঙ্খলে অসামঞ্জস্য বাড়ছে। অনেক প্রাণী বিরল হয়ে পড়ছে। বন্যরা মানুষের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সব চেয়ে বড় কথা, জৈববৈচিত্র্যে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।’’
সবার বক্তব্যেই নীরবে শোনেন উপস্থিত সবাই। প্রশ্নোত্তর পর্বেই ছবিটা বদলে যায়। বরাইল অভয়ারণ্যে কী কী মূল্যবান জন্তু-জানোয়ার রয়েছে, তা জানতে চান ইনস্টিটিউশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অংশুকুমার রায়। হাল্কা ভাবে জবাব দেন মরিস্বামী, ‘‘ওখানে কিছু সরীসৃপ রয়েছে।’’
শুরু হয় প্রশ্নের পর প্রশ্ন। তাদের সুরক্ষায় কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বন বিভাগ? অভয়ারণ্যের কথা বলে বালাছড়া থেকে হারাঙ্গাজাও পর্যন্ত ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরের কাজ আটকে রাখা হল কেন? জায়গায় জায়গায় অভয়ারণ্যের ভিতর দিয়ে জাতীয় সড়ক থাকতে পারলে বরাইলে কেন আপত্তি করা হচ্ছে?
প্রথমে আবছা আবছা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেন বন বিভাগের প্রতিনিধি। মরিস্বামী জানান, সরীসৃপের নিরাপদ চলাচলের জন্য ট্র্যাক তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। বরাইলের হোলক গিবন বা উল্লুক সুরক্ষার কথাও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে বিভাগ। জিজ্ঞাসা বাড়তে থাকায় তাঁকে বলতেই হয়, ‘‘আমি নতুন এসেছি। গত সেপ্টেম্বরে শিলচর অফিসে যোগ দিয়েছি। তবু যে টুকু জানি, বরাইলের বুক চিরে করিডর নির্মাণে রাজ্য সরকারের আপত্তি নেই বলে ন্যাশনাল ওয়াইল্ড লাইফ বোর্ডকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’
আসলে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স (ইন্ডিয়া) এ সব ব্যাপারে জানার জন্যই এই অঞ্চলের চিফ কনজারভেটর বিনয় গুপ্তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বিনয়বাবু নিজে না গিয়ে পাঠিয়ে দেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর মরিস্বামীকে।
অংশুকুমার রায়, ডি পি রায়, বিক্রমজিৎ দাশগুপ্ত, সৌরীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্যরা পরে জানান, তাঁরা বন্যপ্রাণী সুরক্ষার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন বলেই ওই বক্তৃতা শুনতে চেয়েছেন। কিন্তু বরাইল অভয়ারণ্যের নামে বরাকবাসীর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রবঞ্চনা করা হয়েছে। এই অঞ্চল যোগাযোগ পরিকাঠামোয় অত্যন্ত দুর্বল। তাই ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরে যুক্ত হওয়া এখানকার জন্য বড় ব্যাপার ছিল। কিন্তু কেন্দ্র সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর রাজ্য বন বিভাগ বরাইল পাহাড়কে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। তার দরুণ শিলচর-সৌরাষ্ট্র সরাসরি সংযোগের পরিকল্পনায় জটিলতা জড়িয়ে যায়। বালাছড়া থেকে হারাঙ্গাজাও পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার অংশ অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় রাজ্য বন বিভাগ, কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রক, ন্যাশনাল ওয়াইল্ড লাইফ বোর্ডের অনুমোদন জরুরি হয়ে পড়ে। ২০০৪ সাল থেকে সে কাজ আটকে রয়েছে। অন্যান্য অংশে চার লেনের করিডর তৈরি হয়ে ভাঙতে শুরু করেছে, এই অংশের ছাড়পত্র মিলছে না।
বিজেপি এই নিয়ে অনেকদিন থেকে সরব ছিল। তাঁদের বক্তব্য, অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে শিলচর থেকে সৌরাষ্ট্র সড়ক যোগাযোগের প্রকল্প হাতে নেন। তরুণ গগৈয়ের সরকার বরাক-বিদ্বেষী মনোভাবে তার বাস্তবায়নে বাগড়া দিয়েছিল।
এখন অবশ্য কেন্দ্রে-রাজ্যে বিজেপির সরকার। বরাক উপত্যকার ধলাই আসনের বিধায়ক পরিমল শুক্লবৈদ্য রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী। ইস্ট-ওয়েস্ট করিডর নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি বিভাগীয় অফিসারদের এর সর্বশেষ পরিস্থিতির খোঁজখবর করতে বলেছি। তাঁরা আমাকে রিপোর্ট পেশের পর কোথায় জটিলতা রয়েছে, তা খতিয়ে দেখব। পরে কথা বলব কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সঙ্গে।’’ সব সমস্যা মিটিয়ে দ্রুত করিডরের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলেই আশা প্রকাশ করেন তিনি।