হিংসার চিহ্ন। বৃহস্পতিবার সুরাতে। ছবি: পিটিআই।
মোদীর রাজ্যে বাইশ বছরের এক ‘ছোকরার’ এত ক্ষমতা! নাকি সংরক্ষণ আন্দোলনের চরিত্রই এমন উগ্র! মণ্ডল বির্তকে যেমন হয়েছিল, যেমন হয়েছিল গুজ্জরদের আন্দোলনে।
এ যেন সত্যিই এক অচেনা আমদাবাদ! কলকাতায় পুলিশের লাঠি চলেছে আজ, আমদাবাদ-সুরাত-মেহসানায় গত কাল। পটেল সংরক্ষণের দাবিতে অনশনে বসে পড়া কিছু তরুণকে হটাতে পরশু রাতে লাঠি চালিয়েছিল পুলিশ। তারই প্রতিক্রিয়ায় গত কাল আগুন ছড়িয়ে পড়ে গুজরাত জুড়ে। আগুনে লাগিয়ে দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রজনী পটেলের বাড়িতেও। পরিণামে গত কাল বিকেল থেকে রাস্তায় নামে পঞ্চাশ কোম্পানি সেনা ও আধাসেনা। অভিযোগ, ‘উচ্ছৃঙ্খলদের শায়েস্তা’ করতে হাতের সামনে যাকে পায় তাকেই বেধড়ক পেটায়, পটেল মহল্লায় বাড়ি বাড়ি ঢুকে লাঠি চালায় পুলিশ।
সকালে পৌঁছে দেখি সিঁটিয়ে রয়েছে আমদাবাদ। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে নারোডা চৌরাহায় ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা ইটের টুকরো। জলপাই রঙা ট্রাকের মাথায় ইনসাস তাক করে সেনা-জওয়ান। সত্তাধার সার্কেলে সার সার দাঁড়িয়ে পোড়া সরকারি বাস। নারায়ণপুরা, বাপুনাগরে বেলা এগারোটাতেও সদর দরজা দূর, বাড়ির জানালাও ফাঁক হয়নি। ব্যারিকেডে ঘেরা গোটা শহর। পুলিশি-সেনা টহল চলছে। মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহারে আরও দু’দিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সব মিলিয়ে গণ্ডগোলে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০-এ।
আমদাবাদ ওঠে কাকভোরে। খানপুর মোড়ে লাকি রেস্তোরাঁর সামনে সকাল ছ’টায় বাটার টোস্ট-চা’র জন্য লাইন পড়ে। শাহবাগ, দরিয়াপুর, রিলিফ রোডে আটটা বাজলেই গমগম করে দোকানপাট। দশটার আগে দফতরে ঢুকে যান সরকারি কর্মচারীরা। রাজনীতিকদের ডাকা মিছিল-আন্দোলন থেকে এই শহরের মানসিক দূরত্ব অনেকটাই।
তা হলে আগুন লাগল কেন?
মানুষ জানাচ্ছেন, কারণ দু’টো। এক, সামাজিক ব্যাধি। সম্ভ্রান্ত প্রভাবশালী পটেলদের মধ্যে অপ্রাপ্তি ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হ্রাসে অসন্তোষ দানা বাঁধছিল দীর্ঘদিন ধরেই। দ্বিতীয় কারণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা। মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন নিজে পটেল সমাজের। অথচ ঘরে এত বড় অশান্তির
আগুন জ্বলে উঠতে চলেছে, সেটা তিনি বা তাঁর পুলিশ-গোয়েন্দারা বুঝতেই পারেননি।
গুজরাতের পটেলরা আদতে জাঠেদের মতো। কৃষি ও ব্যবসা উভয় ক্ষেত্রেই আধিপত্য রয়েছে তাঁদের। তবু পটেল সমাজের অভিযোগ, প্রচলিত সংরক্ষণ নীতির কারণে শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে পিছিয়ে পড়ছেন তারা। অসন্তোষ রয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়া নিয়েও। অতীতে কেশুভাই পটেলের আমলে পতিদার (পটেল)-রা ছড়ি ঘোরাতেন। পটেল সমাজের প্রতিনিধি হলেও আনন্দীবেনকে ওবিসি নেতা নরেন্দ্র মোদীর ‘পুতুল’ বলেই মনে করেন পতিদারেরা।
ক্রমশ জমতে থাকা এই বারুদেই আগুন লাগানোর কাজটি করেছেন ভুঁইফোঁড় হার্দিক পটেল! পড়াশোনায় একেবারেই মাঝারি মানের, দেখতে-শুনতেও সাধারণ। সর্দার পটেল গ্রুপ নামে গুজরাতে পটেলদের একটি গোষ্ঠী ছিল। কলেজে পড়ার সময়ে আমদবাদের বিরঙ্গম এলাকায় ওই গোষ্ঠীর নেতা হয়ে যান হার্দিক। কলেজ পাশ করার পরে শুরুতে বাবার ব্যবসায় হাত পাকাতে শুরু করেছিলেন। তার পর গত মাসে হঠাৎই সে সব ছেড়ে ‘পতিদার অনামত আন্দোলন সমিতি’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে ফেলেন। যাদের মূল দাবি— শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে পটেলদের সংরক্ষণ। ৬ জুলাই মেহসানাতে তাঁর প্রথম সভা দেখেই চমকে ছিলেন অনেকে। পরে গত ২৩ অগস্ট সুরাতের সভাতেও লক্ষাধিক মানুষের ভিড় হয়। বাকিটা এক অদ্ভুত ‘হিস্টিরিয়া’। অণ্ণা হজারের আন্দোলনের সময় যেমন হয়েছিল। এমনকী হার্দিককে সর্দারের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ‘ছোটা পটেল’ বলেও ডাকতে শুরু করে সংবাদমাধ্যম। ক্রমশ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে হার্দিকের ‘মাহাত্ম্য’ ছড়িয়ে পড়ে গুজরাত জুড়ে। তার পর পরশু আমদাবাদের জিএমডিসি ময়দানে পাঁচ লক্ষ পটেলের সমাবেশ হয় হার্দিকের ডাকে। তিনি হুমকি দেন, মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁদের মঞ্চে এসে সংরক্ষণের দাবি মানতে হবে। নইলে পরের ভোটে বিজেপিকে উৎখাত করে ছাড়বে পটেল সমাজ।
এমনিতেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ দেওয়ার নিয়ম নেই। তা ছাড়া বরাবর প্রভাবশালী পটেলদের সংরক্ষণের দাবি ধোপে টেঁকে না বলেই মনে করে প্রশাসন। আনন্দীবেনও তাই পতিদারদের দাবি উপেক্ষা করে অনশনে বসে পড়া হার্দিককে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন তিনি। গত দু’দিন গুজরাত জুড়ে হওয়া কুরুক্ষেত্রের সেটিই প্রেক্ষাপট।
কিন্তু মূল প্রশ্নটি এখনও অধরা। বাইশ বছরের এক যুবক রাতারাতি এত শক্তি পেলেন কোথা থেকে? মোদী-আনন্দীকে হুমকি দেওয়ার সাহস তিনি পান কোথা থেকে!
ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপি নেতা পুরুষোত্তম রূপালা আজ বলেন, হতে পারে বিজেপির মধ্যেই একাংশ হার্দিককে তাতাচ্ছে। নাম না করলেও তাঁর সন্দেহের তির সঞ্জয় জোশীর দিকে, বিজেপিতে যিনি মোদী-বিরোধী বলেই পরিচিত। তা ছাড়া প্রবীণ তোগাড়িয়ার সঙ্গে হার্দিকের একটি ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। তোগাড়িয়াও পড়েন মোদী-বিরোধী শিবিরেই। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল তাই মনে করে, অস্থিরতা তৈরিতে কলকাঠি নাড়ছেন এই নেতারাই। আবার অনেকের মতে, গোটা ঘটনায় মদত রয়েছে অরবিন্দ কেজরীবাল-নীতীশ কুমারদের। গত লোকসভা ভোটের সময়ে আপ-এর প্রচারে দেখা গিয়েছিল হার্দিককে। তবে শক্তি সিংহ গোহিলের মতো কংগ্রেস নেতাদের সন্দেহ, হয়তো স্বয়ং মোদী-অমিত শাহই রয়েছেন এই খেলার পিছনে। কারণ, হার্দিকের দাবি হল— হয় তাঁদের সংরক্ষণ দেওয়া হোক, নইলে চলতি সংরক্ষণ ব্যবস্থাই খতম করা হোক। কংগ্রেস নেতাদের যুক্তি, এই আন্দোলনের কারণ দেখিয়েই হয়তো ভবিষ্যতে মোদী জাতপাত ভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার পরিবর্তে আর্থিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে সংরক্ষণের প্রস্তাব করবেন।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রজনী পটেলের অবশ্য দাবি, হার্দিকদের কোনও সংগঠন নেই। তাই পুলিশ নামার পরেই হামলাকারীরা গা-ঢাকা দিয়েছে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর শান্তির আবেদনেও মানুষ সাড়া দিয়েছে। আজ বেলা বারোটা থেকে কার্ফু শিথিল করা হয়েছিল। গোটা গুজরাতেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে আর অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে না।’’
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই দাবি কতটা সত্যি! আমদাবাদেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন হার্দিক। সেই গোপন ডেরা থেকে ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘‘দোষী পুলিশদের শাস্তি দিতে হবে। আর পুলিশি অত্যাচারে মৃত যুবকদের পরিবারকে ৩৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নইলে আমদাবাদে সব্জি ও দুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে পটেলরা।’’ সুতরাং অশান্তির আশঙ্কা রয়েই গেল।
সাধারণ মানুষের কথায়— অমিত শাহেরা বুঝতে পারছেন, পুলিশের লাঠিচালনা ভাল ভাবে নেবে না পটেলরা। সেই ক্ষত থেকে ঘা হতে পারে দু’রকম। প্রথমত—অনেক দিন পর ফের গুজরাতে মডেলে দাগ লাগল। দেশ-দুনিয়ায় পটেলরাই এত দিন মোদীর চিয়ারলিডার ছিল। এই ঘটনায় বার্তা গেল মোদীর রাজ্যেই পটেলরা অখুশি। দ্বিতীয়ত— পনেরো শতাংশ পটেলরা বিমুখ হলে ভোটের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েইছে। আমদাবাদের সচিবালয় সূত্র জানাচ্ছে, আনন্দীবেন মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকলেও, আদতে এখন দিল্লি থেকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব সামলাচ্ছেন মোদী। তবু আগুন শেষ পর্যন্ত নিভবে কি না— সেই প্রশ্ন থেকেই গেল।