ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ অভিনয়ে। কিন্তু সম্পন্ন পরিবারের ছেলেকে বিদেশে পাঠানো হল পাইলট হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানেই আমূল ঘুরে গেল জীবনের মোড়। দিল্লির ছেলে গৌরব তিওয়ারি হয়ে গেলেন ‘ভূত’ শিকারি। তাঁর জীবনের পরিণতিও ছিল রহস্যাবৃত। মাত্র ৩২ বছর বয়সে নিজের বাড়ির বাথরুমে রহস্যমৃত্যু হয়েছিল এই তরুণের।
বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিকের ছেলে গৌরবের জন্ম ১৯৮৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর। তাঁকে আমেরিকার টেক্সাসে পাঠানো হয়েছিল বিমানচালনার প্রশিক্ষণ নিতে। কোর্স চলাকালীন ফ্লোরিডায় একটি বাড়িতে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে থাকতেন গৌরব। গৌরবের দাবি, সেখানেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার শিকার হন তিনি।
গৌরবের দাবি, তিনি ও তাঁর বন্ধুরা ওই বাড়িতে অশরীরীর উপস্থিতি টের পেয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতার পর থেকে গৌরবের মনে ‘ভৌতিক’ এবং ‘ভূত’ সংক্রান্ত বিষয়ের উপর দুর্নিবার আকর্ষণ জন্মায়। তিনি ঠিক করেন, এই বিষয়ে গবেষণা করবেন।
আমেরিকার প্যারানেক্সাস অ্যাসোসিয়েশন থেকে স্বীকৃতি পান তিনি। ২০০৯ সালে দেশে ফিরে গৌরব প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল সোসাইটি। ফ্লোরিডার ইনস্টিটিউট অব মেটাফিজিক্যাল সায়েন্স তাঁকে স্পিরিচুয়াল কাউন্সেলর এবং হিপনটিস্টের শংসাপত্র দেয়।
বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্র-সহ ‘ভৌতিক’ বলে পরিচিত এ রকম ছ’হাজারের বেশি বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিলেন গৌরব। নিজের অভিজ্ঞতা জানাতেন ব্লগে বা টেলিভিশনের পর্দায়। তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে, দেশের অন্যতম ভৌতিক ধ্বংসাবশেষ বলে পরিচিত ভানগড় কেল্লায় নাকি আদপেই অশরীরীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
তাঁর এই অভিনব ভাবমূর্তি এবং অভিনয়ের নেশা তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল বিনোদনের দুনিয়াতেও। ‘হন্টেড উইকএন্ড উইথ সানি লিওন’, ‘ভূত আয়া’, ‘ফিয়ার ফাইলস’-এর মতো টেলিভিশন শোগুলির অপরিহার্য অংশ করে তুলেছিল তাঁকে। পাশাপাশি তিনি ইউএফও এবং রহস্যজনক প্রাণী নিয়েও অনুসন্ধিৎসু ছিলেন।
লেখালেখি ও কাজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলেও গৌরব বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর অ্যালেন টাইলারেরও তিনি বন্ধু ছিলেন। দু’জনে একসঙ্গে কাজও করেছেন ‘হন্টিং: অস্ট্রেলিয়া’ সিরিজে।
২০১৬ সালের ৭ জুলাই দিল্লির দ্বারকায় নিজের বাড়িতে রহস্যজনক ভাবে মারা যান গৌরব। তাঁর বাড়ির লোক জানান, সে দিন সকাল ১১টা নাগাদ স্নান করতে ঢোকেন গৌরব। কিছু ক্ষণ পর বাথরুমের ভিতর থেকে জোরে কিছু পড়ার শব্দ হয়।
বাড়ির লোক এর পর গৌরবকে ডেকেও সাড়া না পেয়ে বাথরুমের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন। পুলিশকে তাঁরা জানান, সে সময় গৌরবকে তাঁরা বাথরুমের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। গৌরবের নিথর দেহের গলায় মোটা কালো দাগ ছিল বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
গৌরবের অস্বাভাবিক জীবনধারা তাঁর মৃত্যুকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর বাবা পুলিশকে জানান, মৃত্যুর আগে কয়েক দিন গৌরব জানিয়েছিলেন কোনও এক অশুভ শক্তি তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
বাড়ির লোকদের দাবি, এই কথা গৌরব জানিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী আর্যাকেও। কিন্তু আর্যা ভেবেছিলেন তাঁর স্বামীর হয়তো কাজের চাপে এমন ধারণা হচ্ছে।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অবশ্য গৌরবের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই চিহ্নিত করেছে। যদিও তাঁর কাছের লোকদের দাবি, জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো কিছুই ঘটেনি গৌরবের ক্ষেত্রে। আর্থিক ক্ষতি বা মানসিক অবসাদ, কোনওটারই সম্মুখীন হননি তিনি।
রহস্যমৃত্যুর মাত্র পাঁচ মাস আগে বিয়ে হয়েছিল গৌরবের। পুলিশের দাবি, ভূত সংক্রান্ত কাজ নিয়ে গৌরবের মতান্তর চলছিল তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। এমনকি, তাঁর বাবা মা-ও ছেলের এই আপাত আজব শখ নিয়ে খুশি ছিলেন না।
পুলিশের দাবি, মৃত্যুর আগের দিন রাত একটার সময় বাড়ি ফিরেছিলেন গৌরব। তার পর স্ত্রী এবং বাবা মায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটিও হয়েছিল তাঁর। সে সব দিক তাঁর গোপন করতে চেয়েছেন বলে ধারণা পুলিশের।
তবে অপমৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগেও গৌরব যে স্বাভাবিক ছিলেন, সে বিষয়ে কার্যত নিশ্চিত হতেই হয়। কারণ রেকর্ড বলছে, তিনি সে দিন সকালে নিজের মেল চেক করছিলেন। দিন দু’য়েক আগে একটি পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর ছবি বেরিয়েছিল, সেটাও তিনি পোস্ট করেন।
তা হলে বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে কী এমন হল, যাতে গৌরবকে আত্মঘাতী হতে হল? এই রহস্য রয়ে গিয়েছে কুয়াশায় ঢাকা রহস্য হয়েই।