Maha Kumbh Stampede 2025

কুম্ভে ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট’ মুখ থুবড়ে পড়ল! দায় এড়াতেই কি ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব?

প্রয়াগরাজে শাহি স্নানে ভিড় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যোগী সরকারের পুলিশ, র‌্যাফের পাশাপাশি ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএসএফ-ও। যার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্ত্রকের।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:৫৭
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আশঙ্কা ছিল গোড়া থেকেই। কিন্তু গত কয়েক মাসে বারে বারেই তা উড়িয়ে দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং তাঁর সরকারের মন্ত্রী আধিকারিকেরা। পদপিষ্টের সম্ভাবনা এড়িয়ে কোটি কোটি পুণ্যার্থীর নিশ্ছিদ্র সুরক্ষার আয়োজনের দাবি করেছেন তাঁরা। যাকে অভিহিত করেছেন এক নতুন শব্দবন্ধে— ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট’। কিন্তু বুধবার ভোরে প্রয়াগরাজে মৌনী অমাবস্যার শাহি স্নানের গোড়াতেই সামনে চলে এল ভিড় সামলানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যর্থতার ছবি। যার তুলনা টানতে অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে সেই পুরনো প্রবাদ— বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া।

Advertisement

মঙ্গলবার গভীর রাতেই হুড়োহুড়ি থেকে পদপিষ্টের ঘটনা শুরু হয়েছিল প্রয়াগরাজে। দিনভর নিশ্চুপ থাকার পর বুধের সন্ধ্যায় প্রয়াগরাজের ডিআইজি বৈভব কৃষ্ণ সাংবাদিক বৈঠক জানিয়েছেন, গঙ্গা, যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতী নদীর সঙ্গমে পদদলিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৩০ জনের। গুরুতর আহত কমপক্ষে ৬০ জন। প্রয়াগরাজে শাহি স্নানে ভিড় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যোগী সরকারের পুলিশ, র‌্যাফের পাশাপাশি ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএসএফ-ও। যার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্ত্রকের।

এই পরিস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ ইতিমধ্যেই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছে। তাদের অভিযোগ, জনা দুয়েক যুবক গভীর রাতে হঠাৎ ত্রিবেণী সঙ্গমের ভিড়ে বোমার গুজব ছড়ায়। আর তা থেকেই সৃষ্টি হয় হুড়োহুড়ি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথও বুধবার পুণ্যার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘‘কোনও গুজবে কান দেবেন না।’’ যদিও যোগীর বিবৃতিতে প্রাণহানির উল্লেখটুকুও নেই! বিরোধীদের একাংশের অভিযোগ, গাফিলতি এড়াতে শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের তত্ত্বকেই ‘হাওয়া দেবে’ উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার।

Advertisement

কী ভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?

প্রয়াগরাজের ত্রিবেণী সঙ্গমে মৌনী অমাবস্যায় ‘শাহি স্নানে’র সময় ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছিল যোগী সরকার। তা সত্ত্বেও কেন দুর্ঘটনার শিকার হলেন পুণ্যার্থীরা? প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার রাত আড়াইটে নাগাদ একসঙ্গে প্রচুর মানুষ সঙ্গমের তীরে এসে পৌঁছেছিলেন। অনেকেই মাথায় ভারী মালপত্র নিয়ে এসেছিলেন স্নান করতে। নদীর তীরে লোহার বেশ কিছু ডাস্টবিন রাখা ছিল, যা ভিড়ের মধ্যে অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। তাতেই ধাক্কা খেয়ে বহু পুণ্যার্থী মাটিতে পড়ে যান। মাথায় থাকা মালপত্রও ছিটকে পড়ে। মালপত্র এবং মাটিতে পড়ে যাওয়া পুণ্যার্থীদের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আরও অনেকে পড়ে যান। তাঁদের মাড়িয়েই এগোতে থাকেন অন্যেরা। ভিড়ের চাপে ভেঙে পড়ে অনেকগুলি ব্যারিকেড। চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় আধাসেনা।

বস্তুত, মৌনী অমাবস্যা উপলক্ষে কোটি কোটি মানুষের ভিড় হয়েছিল প্রয়াগরাজে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই ত্রিবেণী সঙ্গমে ‘অমৃত স্নান’ করতে জড়ো হতে শুরু করেছিলেন পুণ্যার্থীরা। প্রকাশিত কিছু খবরে দাবি, রাত গড়াতে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণেই পুণ্যার্থীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। আচমকা ধাক্কাধাক্কি শুরু হওয়ায় ভিড়ের মধ্যে আটকে পড়েন অনেকে। তবে দুর্ঘটনার পর পরই উদ্ধারকাজ শুরু হয়। আহতদের উদ্ধার করে মেলাপ্রাঙ্গণেরই হাসপাতালে আনা হয়। মেলাপ্রাঙ্গণের প্রশাসনিক আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, অনেককেই মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়।

ভিড় নিয়ন্ত্রণে কী করেছিল যোগীর পুলিশ?

ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে ত্রিবেণী সঙ্গম থেকে এক কিলোমিটার দূরে বাঁশের ব্যারিকেড তৈরি করেছিল প্রশাসন। বিশৃঙ্খলা এড়াতে জ়োন ভাগ করে করে ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। রাত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, রাত ১২টা পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু তার পর থেকে ভিড়ের ছবিটা ক্রমে বদলাতে শুরু করে। রাত ২টোয় পরিস্থিতি পুরো বদলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকেই পুণ্যার্থীরা দলে দলে এগোতে শুরু করেন সঙ্গমের দিকে।

পুলিশ চেষ্টা করেছিল, পুণ্যার্থীরা আসুক, স্নান সেরে আবার ফিরে যাক। মাইকে তা ধারাবাহিক ভাবে প্রচারও করা হচ্ছিল। কিন্তু স্নানের পরেও বহু পুণ্যার্থী সঙ্গমস্থলের আশপাশেই ছিলেন। অনেকে আবার প্লাস্টিক পেতে মাটিতে শুয়েও পড়েছিলেন। সঙ্কটের মুহূর্তে যা মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনে।

আখড়াগুলির জন্য সঙ্গমের পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল পুলিশ-প্রশাসন। বুধবার সকাল ৫টা থেকে সেই পথ ধরেই আখড়ার সদস্যদের সঙ্গমে স্নান করতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার রাত ১টার পর থেকেই সেই পথও পুণ্যার্থীদের ভিড়ে অবরুদ্ধ হয়ে যায় বলে পুণ্যার্থীদের দাবি। প্রশাসনের পরিকল্পনা ছিল, শাহি স্নানের পরে চিহ্নিত ব্যারিকেড ঘেরা পথ দিয়েই পুণ্যার্থীদের ফেরানো হবে। কিন্তু ভিড় এতটাই বেড়ে যায় যে, রাত রাত ২টোর পরে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাত ২টোর পর থেকে বহু পুণ্যার্থী ব্যারিকেড টপকে, ভেঙে এগোনোর চেষ্টা করেন। তাতেই বিপত্তি। ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খান নিরাপত্তাকর্মীরা। অনেকেই ব্যারিকেড টপকে গিয়ে ঘুমন্ত পুণ্যার্থীদের গায়ে গিয়ে পড়েন। তার পরই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

পূর্ণকুম্ভে কুম্ভীপাক এবং তার পর

ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করতে গিয়ে পদপিষ্টের ঘটনার পর বুধবার ভোর থেকেই স্থানীয় উদ্ধারকারী দল পরিস্থিতি সামাল দিতে নেমেছিল। এর পর ঘটনাস্থলে পৌঁছয় রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। এ ছাড়াও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও উদ্ধারকাজে হাত লাগায়। পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপ না হয়, সেই কারণে ঘটনাস্থলে র‌্যাফ নামানো হয়। ভিড় নিয়ন্ত্রণে নামে পুলিশের ঘোড়সওয়ার বাহিনী। এমনকি, মোতায়েন করা হয়, একদা ভিআইপি নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এনএসজি (ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড) কমান্ডোদেরও।

বিপর্যয়ের প্রাথমিক রেশ কাটার পরে ত্রিবেণী সঙ্গমে আবার শুরু হয় পুণ্যস্নান। সেই সঙ্গে আকাশপথে চলে ‘পুষ্পবৃষ্টি’। বস্তুত, মৌনী অমাবস্যায় শাহি স্নানের সময়ে আকাশপথে ‘পুষ্পবৃষ্টি’ করা হবে বলে আগেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল আদিত্যনাথ প্রশাসন। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে বিপর্যয়ের পর স্নান সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফাঁকা করে দেওয়া হয় গঙ্গা, যমুনা এবং অন্তঃসলিলা সরস্বতীর সংযোগস্থল। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবার স্নান শুরু হয়। হেলিকপ্টারে ত্রিবেণী সঙ্গমে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দেওয়া হয় পরিকল্পনা মেনেই।

যোগীকে ফোন মোদীর, বন্ধ ‘শাহি স্নান’

মহাকুম্ভে পদপিষ্টের ঘটনায় পরেই সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথকে ফোন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও যোগীকে ফোন করে পরিস্থিতির খবর নেই।

অন্য দিকে, পদপিষ্টের ঘটনার পরই মৌনী অমাবস্যায় ‘শাহি স্নান’ আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাধুদের আখড়াগুলি। অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদের সভাপতি মহন্ত রবীন্দ্র পুরী এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। তাঁর কথায়, ‘‘কী ঘটেছে, তা সকলেই দেখতে পেলেন। সেই কারণেই আমরা মৌনী অমাবস্যায় স্নান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’

পদপিষ্টের ঘটনায় শোকপ্রকাশ করেছেন মোদী। তিনি জানান, প্রয়াগরাজে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। স্বজনহারা পরিবারদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে আহতদের দ্রুত সুস্থ কামনা করেছেন তিনি। শোকপ্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুও। মহাকুম্ভে পদপিষ্টের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় প্রশাসনকে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, ত্রিবেণী সঙ্গমে ‘শাহি স্নান’ করতে আসা পুণ্যার্থীদের ‘সংযত’ থাকার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আর্জি, ‘‘কোনও গুজবে কান দেবেন না। যে যেখানে আছেন, কাছাকাছি ঘাটে স্নান করুন।’’

‘পদদলিত’ রাজনীতি

প্রয়াগরাজে পদপিষ্টের ঘটনায় রাজনৈতিক চাপানউতরের পারদ চড়েছে বুধের সকাল থেকেই। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি (এসপি)-র সভাপতি ‘বিশ্বমানের ভিড় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’ নিয়ে খোঁচা দিয়েছেন যোগীকে। তাঁর দাবি, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহাকুম্ভে আসা সাধুসন্ত ও পুণ্যার্থীদের আস্থা ফেরাতে রাজ্য সরকারের উচিত অবিলম্বে সেনার হাতে মেলাপ্রাঙ্গণের দায়িত্বভার তুলে দেওয়া। অখিলেশের কথায়, ‘‘বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা বলে প্রচার চালানো হয়েছিল। কোথায় সে সব? এ বার সকলের সামনে প্রকৃত সত্য চলে এসেছে। যাঁরা মিথ্যা দাবি করেছিলেন, মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছিলেন, তাঁদের সকলকে এই মৃত্যুর দায় নিতে হবে। তাঁদের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত!’’

মৌনী অমাবস্যার শাহি স্নানে ভক্তদের বিপুল জমায়েত নিয়ন্ত্রণ করতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও। তিনি বলেন, ‘‘অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা, সাধারণ মানুষের তুলনায় ভিআইপিদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া— এ সবের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধুমাত্র বিশেষ ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া এ বার বন্ধ করা উচিত। ভবিষ্যতে আর যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্যও যথাযথ পদক্ষেপ করা উচিত সরকারের।’’ একই সুর কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের গলাতেও। দুর্ঘটনার পরেই খড়্গে বলেন, ‘‘যথাযথ প্রস্তুতি না থাকা, ভিআইপিদের অগ্রাধিকার দেওয়া, ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে আত্মপ্রচারে জোর দেওয়া, এ সবই দুর্ঘটনার নেপথ্য কারণ। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও এ রকম ব্যবস্থাপনা আশা করা যায় না! এ বার অন্তত কেন্দ্র ও রাজ্যের চোখ খুলুক!’’

মমতা টানলেন গঙ্গাসাগর

কুম্ভমেলায় পদপিষ্টের ঘটনার পর ১০ ঘণ্টা অতিক্রান্ত। বেশ কয়েক জনের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। আহত হয়েছেন বহু মানুষ। ঘটনাস্থল জুড়ে বর্তমানে শুধুই হাহাকার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় শশব্যস্ত প্রশাসন। সেই আবহেই এ বার সরব হয়েছেন বিরোধীরা। আঙুল উঠল উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের দিকে।

এ রাজ্যের গঙ্গাসাগর মেলার উদাহরণ দিয়ে ‘শিক্ষা’ নেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক্স হ্যান্ডলে মমতার পোস্ট, ‘‘কুম্ভমেলায় পদপিষ্টের ঘটনায় অনেকের মৃত্যুর খবর শুনে আমি মর্মাহত। নিহতদের শোকস্তব্ধ পরিজনদের সমবেদনা জানাই। আমাদের গঙ্গাসাগর মেলা থেকে শিখেছি, এ ধরনের বিপুল জনসমাগমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার দরকার হয়। নিহতদের পরিবারের জন্য প্রার্থনা রইল।’’

‘ফাঁকফোকরের’ বার্তা ছিল ১৯ তারিখেই

গত ১৯ জানুয়ারি কুম্ভমেলায় আগুন ছড়িয়েছিল। ১৯ নম্বর সেক্টরে গীতা প্রেসের তাঁবু জ্বলে উঠেছিল দাউদাউ করে। সেখান থেকে আশপাশের কিছু তাঁবুতেও আগুন ছড়ায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছিল ৫০টিরও বেশি তাঁবু। তাঁবুগুলির ভিতর থেকে পর পর সিলিন্ডার ফাটার শব্দও পাওয়া গিয়েছিল। মহাকুম্ভ উপলক্ষে প্রয়াগরাজে তখনও কয়েক কোটি পুণ্যার্থীর ভিড় ছিল বলে উত্তরপ্রদেশ সরকারের দাবি। বিস্তীর্ণ মেলাপ্রাঙ্গণকে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে নজরদারি চালানো হচ্ছে বলে পুলিশ-প্রশাসন জানিয়েছিল। জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছিল বলে দাবি। পুলিশের পাশাপাশি সর্ব ক্ষণ মোতায়েন ছিলেন দমকলকর্মীরা। অগ্নিকাণ্ডের পর পদপিষ্টের ঘটনা— কুম্ভমেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

কিছুটা ব্যক্তিগত

‘‘ভিড়ের চাপে ব্যারিকেড ভাঙল আচমকা, অনেকে পড়ে গেলেন!’’ মহাকুম্ভে কী ভাবে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে তা জানাতে গিয়ে এমনই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন বিবেক মিশ্র। মা-বাবাকে নিয়ে পুণ্যস্নানে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এমন পরিস্থিতি হবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি উত্তরপ্রদেশর বাসিন্দা বিবেক। তাঁর অনুমান, স্নানের পর অনেক মানুষই দিশাহীন হয়ে পড়েছিলেন। কোথায় যেতে হবে, তা জানা ছিল না তাঁদের। তাই ভিড়ের সঙ্গে তাল না রেখে এ দিক-ও দিক যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর তাতেই বিপত্তি। তাঁর কথায়, ‘‘আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।’’

উত্তরপ্রদেশেরই ফতেপুরের বাসিন্দা রাম সিংহের অভিজ্ঞতা আরও ভয়ানক। ভিড়ের মধ্যে পড়ে পায়ে আঘাত পান তিনি। সাহায্যের জন্য চিৎকার করেও লাভ হয়নি বলে দাবি তাঁর। রামের কথায়, ‘‘কেউ এগিয়ে আসেননি। ভিড়ের চাপে বন্ধুরাও ছিটকে যান। কোথায় যাবেন, কী করবেন— কিছুই বুঝতে উঠতে পারছিলেন না। কোনওক্রমে আহত অবস্থায় ভিড়ের সঙ্গে তাল রেখে বাইরে যাওয়ার গেটের কাছে পৌঁছন। তার পর এক পুলিশকর্মীর সহায়তায় অ্যাম্বুল্যান্সে করে হাসপাতালে যান রাম।

কেউ বোন, কেউ পুত্র, কেউ বাবা, কেউ মা, কেউ আবার বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছেন। হাসপাতালে হাসপাতালে পরিজনদের খুঁজছেন অনেকেই। কেউ আবার মর্গের বাইরে অসহায় অবস্থায় অপেক্ষা করছেন। প্রয়াগরাজে এখন এমনই দৃশ্য। মহাকুম্ভমেলার বাইরে এক পরিবার অসহায় হয়ে বসেছিল। তাদের আর্তি, ফিরে আসুক ছোট্ট ছেলেটা।

পদপিষ্টের ঘটনা অনেকেরই মনে ফিরিয়ে দিয়েছে পুরনো স্মৃতি। ১৯৫৪ সালে ব্যবসায় সর্বস্বান্ত স্বামীর অবস্থা ফেরানোর ব্রত নিয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জের বাসিন্দা উমা ভট্টাচার্য। অনেকের সঙ্গে কলকাতা থেকে ইলাহাবাদ (বর্তমানের প্রয়াগরাজ)-এর কুম্ভে পুণ্যস্নান করতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আর ফেরেননি। কোথায় গেলেন তিনি, আদৌ বেঁচে আছেন কি না, তা জানতেই পারেনি উমার পরিবার। তবে সে বার কুম্ভে একটি পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছিল। তাতে প্রাণ গিয়েছিল অন্তত ৫০০ জনের। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই পারিবারিক ভাবে এ কথা শুনে এসেছেন তাঁর দৌহিত্র সুমিত ভট্টাচার্য। বুধবার প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে আবারও একটি পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে। তাতে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। আর এই ঘটনাই উস্কে দিয়েছে প্রায় ৭০ বছর ধরে জমে থাকা সুমিতের পারিবারিক স্মৃতি। সুমিতের মায়ের বয়স তখন ১০ বছর। সেই সময়েই তাঁর দিদিমা কুম্ভে গিয়ে ‘নিখোঁজ’ হন। ছোট থেকে সুমিত তাঁর মা কৃষ্ণাদেবীর থেকেই ১৯৫৪ সালের কুম্ভের দুর্ঘটনার কথা শুনে বড় হয়েছেন। সেই দুর্ঘটনায় সুমিতের মায়ের মতো বহু জন স্বজনহারা হয়েছিলেন। মধ্যবয়সি সুমিত যদিও বিশ্বাস করেন, ১৯৫৪ সালের কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর দিদিমার। তবে এর কোনও প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।

বাতিল হয়নি স্পেশ্যাল ট্রেন, তবে কিছু অভিমুখ বদল

প্রাথমিক ভাবে খবর ছড়িয়েছিল, কুম্ভমেলার জন্য পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন (সাবেক মুঘলসরাই) থেকে প্রয়াগরাজগামী বিশেষ ট্রেনগুলির পরিষেবা সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হয়েছে। যদিও এর পরে রেল মন্ত্রককে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, কোনও বিশেষ ট্রেনই বাতিল করা হয়নি। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত প্রয়াগরাজগামী বহু ট্রেনের অভিমুখ বদল করা হয়েছে বলে খবর। বুধবার সকাল থেকেই পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশনে বহু মানুষের ভিড়। তাঁদের মধ্যে পুণ্যার্থীদের পাশাপাশি রয়েছেন অন্য যাত্রীরাও। এএনআই জানিয়েছে, প্রয়াগরাজ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ৩৬০টিরও বেশি ট্রেন চালানো হবে।

কুম্ভের ‘পদপিষ্ট ইতিহাস’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ১৯৫৪ সালে প্রয়াগরাজে কুম্ভের আয়োজন করা হয়েছিল। ভারতে তখন নতুন সরকার। বড় দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না। ওই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি মৌনী অমাবস্যা উপলক্ষে কোটি কোটি মানুষের জমায়েত হয়েছিল ইলাহাবাদের মেলাপ্রাঙ্গণে। সেই ভিড়েই পদপিষ্টের ঘটনায় ৫০০ জনের বেশি পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছিল।

তার পরে দেশে সরকার সাবালক হয়েছে ধীরে ধীরে। কিন্তু কুম্ভস্নানে গিয়ে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। ১৯৮৬ সালের কুম্ভতেও পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। ওই বছর হরিদ্বারে কুম্ভমেলা হয়। সেই কুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে অনেকে পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়। কী কারণে পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছিল? সেই সময়কার বিভিন্ন প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং সাংসদদের সঙ্গে কুম্ভে স্নান করতে এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর সিংহ। তাঁদের নিরাপত্তার কারণে সাধারণ পুণ্যার্থীরা নদীর কাছাকাছি পৌঁছতে বাধা পান বলে অভিযোগ ওঠে। আর তাতেই ভিড় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিভিন্ন সূত্রের দাবি, পদপিষ্টের ঘটনায় সে বার ২০০ জনের বেশি পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছিল।

১৯৮৬ সালের পর দীর্ঘ সময় কুম্ভমেলায় কোনও পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০০৩ সালে নাসিকে অনুষ্ঠিত কুম্ভমেলায় পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, সেই দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হন শতাধিক।

২০১০ সালের কুম্ভেও পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। সে বছর হরিদ্বারে আয়োজিত হয়েছিল কুম্ভমেলা। ১৪ এপ্রিল, ২০১০ সালে ‘শাহি স্নান’-এর সময় বিপর্যয় ঘটে। ‘শাহি স্নান’ করতে আসা সাধুসন্তদের সঙ্গে সাধারণ পুণ্যার্থীদের সংঘর্ষ বেধে গিয়েছিল। তাতেই পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। সে বছর সাত জনের মৃত্যু হয়েছিল।

ঠিক তার তিন বছর পর ২০১৩ সালে প্রয়াগরাজের কুম্ভে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সে বার মেলাপ্রাঙ্গণে নয়, দুর্ঘটনা ঘটেছিল ইলাহাবাদ স্টেশনে। পদপিষ্টে ঘটনায় ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই বছর ইলাহাবাদ স্টেশনে একটি ফুটব্রিজের রেলিং ভেঙে বিপত্তি ঘটে। রেলিং ভেঙে পড়ায় স্টেশনে থাকা যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন মহিলা।

২০১৩ সালের পর ২০২৫। পদপিষ্টের ঘটনায় অনেকের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। আহত আরও অনেকে হাসপাতালে ভর্তি। স্বজনদের খোঁজে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন বহু পুণ্যার্থী। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী থেকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ-সহ সকলেই। অন্য দিকে, বিরোধীরা চরম অব্যবস্থার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে। তবে কুম্ভে দুর্ঘটনার বিষয় নতুন নয়। বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান কুম্ভমেলা। অতীতেও পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement