ধোঁয়াবিহীন তামাক আসলে সিগারেট-বিড়ির মতোই ক্ষতিকর, রায় চিকিৎসকদের। এই অবস্থায় জর্দা দেওয়া পানমশলা তৈরি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট, ২০০৬’ (এফএসএস) লঙ্ঘনের জন্য পানমশলা প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছে তারা।
অঙ্কিত গুটখা বনাম ইন্ডিয়ান অ্যাজমা সোসাইটির মামলায় একটি পিটিশন দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রকের কাছে। সেই পিটিশনের ভিত্তিতে শীর্ষ আদালত ২৩ সেপ্টেম্বর নির্দেশ জারি করেছে, জর্দা দেওয়া পানমশলা তৈরি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে কেন্দ্রকেই। চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, সিগারেট-বিড়ির মতো ক্ষতিকর বলেই ধোঁয়াবিহীন ওই সব তামাক নিষিদ্ধ করা দরকার। ক্যানসার রোগীর সংখ্যা যে-হারে বাড়ছে, সেটা শুধু চিকিৎসক নয়, সব স্তরের মানুষেরই চিন্তার বিষয়। সেই সব দিক বিবেচনা করেই সর্বোচ্চ আদালত এই নির্দেশ দিয়েছে বলে মনে করছেন ওই চিকিৎসকেরা।
পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্যের মোট ক্যানসার রোগীর এক-তৃতীয়াংশ মুখ ও গলার ক্যানসারে আক্রান্ত। ‘এফএসএস অ্যাক্ট, ২০০৬’ অনুযায়ী এই আইনের অন্তর্গত সব রকম খাদ্যপণ্য স্বাস্থ্যকর ও সুরক্ষিত হওয়া উচিত। তাই এফএসএসের আওতায় থাকা কোনও সংস্থা তামাকপণ্য উৎপন্ন বা বিক্রি করতে পারে না। চিকিৎসকদের একাংশের আশা, শীর্ষ আদালতের নির্দেশ পানমশলা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে সচেতন করবে। অন্তত আইনের জটিলতা থেকে বাঁচার তাগিদ থেকেই গুটখা, সুপারি দিয়ে পানমশলা তৈরি অবিলম্বে বন্ধ করে দেবে তারা।
ধূমপানের তামাকের সঙ্গে সঙ্গে জর্দা-গুটখা-পানমশলার মতো জিভে দেওয়া তামাকের বিক্রি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে সওয়াল করে আসছে। প্রচারও চলছে কমবেশি। বিধিনিষেধও জারি হয়েছে কিছু কিছু। তা সত্ত্বেও মোড়ে মোড়ে দোকানে দোকানে রীতিমতো সাজিয়েগুছিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে হরেক কিসিমের জর্দামাখা গুটখা ও পানমশলা। বড়দের সঙ্গে ছোটরাও তা কিনে খাচ্ছে দেদার। টিভি-সংবাদমাধ্যমে তামাকসেবনের অপকারিতা নিয়ে সতর্কতার পাশেই থাকছে দেখনদারি সিগারেট-গুটখা-পানমশলা ইত্যাদির বিজ্ঞাপন। সেই সব বিজ্ঞাপনে চিত্রতারকাদের সামিল করে জনমনোহরণের চেষ্টা সর্বগ্রাসী। বিশেষত কিশোর-তরুণেরা ওই তামাকনেশার কবলে পড়ায় নতুন প্রজন্মের উপরে কালান্তক ছায়া বিস্তার করছে ক্যানসার। এই সমূহ সর্বনাশের আশঙ্কা উদ্বিগ্ন করে তুলছে চিকিৎসকদের। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত উদ্যোগে খুব একটা কাজ যে হচ্ছে না, সিগারেট-বিড়ির সঙ্গে সঙ্গে জর্দামাখা পানমশলার ঢালাও ব্যবসাই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
সরকারের সদিচ্ছা আর সক্রিয়তাই পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে পারে বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু সরকারের তরফে বাস্তবে তামাক-বিধি প্রয়োগের চেষ্টা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এই পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে আশার আলো দেখছে চিকিৎসা-জগৎ।
কেন্দ্রকে শীর্ষ আদালতের নতুন নির্দেশ দেওয়ার প্রেক্ষাপটটি রীতিমতো চমকপ্রদ। মাস চারেক আগে তামাক নিয়ে সংসদে রিপোর্ট পেশ করেছিল দু’টি কমিটি। সেই দু’টিই সরকারি কমিটি হওয়া সত্ত্বেও তাদের রিপোর্টে মূল মতামতের পার্থক্য ঘোর বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে। একটি কমিটির রিপোর্ট জানায়, তামাক মানুষের শরীর ও পরিবেশ দুইয়েরই ক্ষতি করছে। তাই এই জোড়া সর্বনাশ ঠেকাতে সরকারকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু অন্য কমিটি তাদের রিপোর্টে জানায়, তামাক ক্ষতিকর কি না, সেটা নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। তাই তামাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা অর্থহীন। একই সরকারের দু’টি কমিটির রিপোর্ট কী ভাবে এমন আদ্যোপান্ত পরস্পরবিরোধী হতে পারে, তখন সেই প্রশ্ন উঠেছিল।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, তামাক শিল্পের লবি এমনিতেই প্রভূত শক্তিশালী। তার উপরে দু’টি সরকারি কমিটির মতবিরোধের মাঝখানে পড়ে তামাকের শিকার হয়ে চলেছে আমজনতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী জর্দামাখা পানমশলা, গুটখা নিষিদ্ধ হলে বালক-কিশোর থেকে বয়স্ক পর্যন্ত সকলেই কিছুটা নিস্তার পাবেন। শুধু নিষেধাদেশ নয়, চিকিৎকেরা চান তার সক্রিয় প্রয়োগও। তাঁরা বলছেন, কার্যক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ না-করলে তা তো শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। আর জর্দা-গুটখা-পানমশলার গ্রাসে জনস্বাস্থ্য যে-ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে, তেমনটাই চলবে। সেটা যাতে না-হয়, সরকারকেই তা নিশ্চিত করতে হবে।