গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
সন ১৯৫২, প্রথম সাধারণ নির্বাচন স্বাধীন ভারতে। লোকসভার জন্য শুধু নয়, সব ক’টি রাজ্যের বিধানসভার জন্যও ভোট হল। ভোট মেটার পরে হিসেব কষে দেখা গেল, রাজকোষ থেকে খরচ হয়েছে ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকার মতো।
সন ২০১৪, ষোড়শ সাধারণ নির্বাচন স্বাধীন ভারতে। মূলত লোকসভার জন্যই ভোট। সঙ্গে মাত্র ৪টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। ভোট মেটার পরে নির্বাচন কমিশন দেখল, খরচ হয়ে গিয়েছে ৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকারও বেশি।
এর পরে আরও ২৫টি রাজ্য এবং ২টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সে সবের খরচ আলাদা। সে সবের জন্য নিরাপত্তার বন্দোবস্ত তথা বাহিনী পাঠানোর খরচ আলাদা। নির্বাচন এলেই অন্য সব কাজ শিকেয় তুলে শুধু ভোট নিয়েই প্রশাসনের ব্যস্ত হয়ে পড়ার ঝক্কি আলাদা। বার বার নির্বাচনী আচরণ বিধি লাগু হওয়ায় উন্নয়নমূলক কাজকর্ম থেমে যাওয়ার সমস্যা আলাদা।
আরও পড়ুন: মোদীর বৈঠকে নেই রাহুল, মমতার মতোই বয়কটে মায়া-অখিলেশ-স্ট্যালিন
অর্থ, সময় এবং প্রশাসনিক সক্ষমতার এই অপচয় রুখতে এবং দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সরল করতে ভারত সরকারের প্রস্তাব— ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’। অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচন এবং ২৯টি রাজ্য ও দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গেই করার প্রস্তাব।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বছরখানেক আগেই এই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে দেশের আইন কমিশনও সক্রিয় হয়েছে। গোটা দেশে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে করানোর যে প্রস্তাব, তার বিভিন্ন দিক কমিশন ব্যাখ্যা করেছে। এই নীতি রূপায়ণের জন্য আইনে এবং সংবিধানে কী ধরনের পরিবর্তন বা সংশোধন আনা দরকার, সে বিষয়ে আইন কমিশন কিছু সুপারিশও ইতিমধ্যেই পেশ করেছে। সে সব সুপারিশ এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে পরিষ্কার যে, এই নীতির রূপায়ণ খুব সহজ-সরল কোনও প্রক্রিয়া নয়।
রূপায়ণের প্রশ্নে অবশ্য পরে আসা যাবে। তার আগেই প্রশ্ন ওঠা উচিত, দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অর্থাৎ ১৯৫২ সালে যদি লোকসভা এবং সব রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে হয়ে থাকে, তা হলে এখন আর তা হয় না কেন?
১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কিন্তু নির্বাচনগুলো একসঙ্গেই হত। কিন্তু তার পরে বেশ কিছু রাজ্যের সরকার মাঝপথেই ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে সেই সব রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময় বদলে যায়। ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে যে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার আসে, সে সরকারও মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেনি। তাই ১৯৮০ সালে দেশ প্রথম বার অকাল নির্বাচনের মুখোমুখিও হয়। তার পরে সে রকম ঘটনা আরও বেশ কয়েক বার ঘটেছে। ফলে এখন লোকসভা নির্বাচন একটা সময়ে, বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন বিভিন্ন সময়ে, তার বাইরে পুরসভা বা পঞ্চায়েতের নির্বাচন তো রয়েছেই। অর্থাৎ পাঁচ বছর অন্তর নয়, প্রায় প্রতি বছরই দেশের প্রায় প্রতিটা প্রান্তে কোনও না কোনও নির্বাচন লেগেই থাকে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি প্রণয়নে উদ্যোগী হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
আরও পড়ুন: রাম আর আল্লাকে মিলিয়ে দিয়ে সংসদে নতুন ইনিংসের শুরুতেই সেঞ্চুরি অধীরের
এই নীতির রূপায়ণ ঘটাতে হলে কী করতে হবে? সংবিধানের অনেকগুলো ধারাকে সংশোধন করতে হবে।
কোন কোন ধারা সংশোধন করতে হবে?
ধারা ৮৩— সংসদের দুই কক্ষের মেয়াদের কথা বলা হয়েছে এই ধারায়।
ধারা ৮৫— লোকসভা ভেঙে দেওয়ার নিয়ম নথিবদ্ধ রয়েছে এই ধারায়।
ধারা ১৭২— রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদের কথা বলা রয়েছে এই ধারায়।
ধারা ১৭৪— বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার নিয়ম নথিবদ্ধ রয়েছে এই ধারায়।
ধারা ৩৫৬— রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার বিধি নথিবদ্ধ রয়েছে এই ধারায়।
এ ছাড়াও বিছু বদল আনতে হবে ১৯৫১ সালে তৈরি হওয়া জনপ্রতিনিধিত্ব আইনেও।
কেন এই সব সংশোধন জরুরি?
এই সব সংশোধন না হলে, স্থায়ী ভাবে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ ব্যবস্থা ধরে রাখা যাবে না। কেন ধরে রাখা যাবে না? একটু বিশদে বুঝে নেওয়া যাক:
পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ সালে হবে। সেই বছরেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি রূপায়ণের লক্ষ্য নিয়ে যদি এগোতে হয়, তা হলে বেশ কিছু রাজ্যে বিধানসভার মেয়াদ ফুরনোর আগেই তা ভেঙে দিয়ে নির্বাচনে যেতে হবে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে বা অসমে বিধানসভা নির্বাচন হবে ২০২১ সালে। গুজরাতে বা উত্তরপ্রদেশে হবে ২০২২ সালে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ বা অসমে পরবর্তী বিধানসভার মেয়াদ থাকবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত আর উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাতের ক্ষেত্রে তা হবে ২০২৭। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই এই সব রাজ্যে বিধানসভা ভোটও সেরে ফেলতে হলে, মেয়াদ ফুরনোর ৩ বছর বা ২ বছর আগেই সরকার তথা বিধানসভা ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু এই এক বার গোটা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন করিয়ে দিলেই যে পরবর্তী ৫ বছরে কেন্দ্রে এবং সব ক’টি রাজ্যে স্থিতিশীল ভাবে সরকার চলবে, কোথাও কোনও সরকার যে মাঝপথেই পড়ে যাবে না, কোথাও যে ৩৫৬ ধারা জারির করার প্রয়োজন হবে না, এমনটা জোর দিয়ে বলার ক্ষমতা এই সুবিশাল গণতন্ত্রে কারও নেই। তাই মাঝপথে কোথাও কোনও সরকার ভাঙলেই আবার আলাদা আলাদা সময়ে নির্বাচনের পরম্পরা ফিরে আসবে। সেই কারণেই সরকারকে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা সংশোধনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে যে, অকাল নির্বাচন কোথাও হবে না।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, সরকারের টিকে থাকা বা না থাকা যদি লোকসভা বা বিধানসভায় আসনসংখ্যার উপরে নির্ভর করে, তা হলে ৫ বছরের আগে নির্বাচন না হতে দেওয়া সুনিশ্চিত করা অসম্ভব। সম্ভব তখনই, যখন ভারতও আমেরিকার ধাঁচে রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রিক সরকার গঠন করার পথ নেবে। কিন্তু ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে সরকারগুলো রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রিক বা রাজ্যপাল কেন্দ্রিক করে তোলা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিতর্ক বিস্তর।
আরও পড়ুন: নারদ-কাণ্ডে ফের ম্যাথুকে সিবিআই তলব, দ্বিতীয় দফায় অভিযুক্তদের জেরার প্রস্তুতি
তাই সংবিধান বিশেষজ্ঞরা আরও একটা পন্থার কথাও আলোচনা করছেন— সরকার পড়লে পড়ুক, বিধানসভা বা লোকসভা ভাঙবে না। অর্থাৎ কেন্দ্রে বা রাজ্যে যদি সরকার মাঝপথে পড়ে যায়, তা হলে আইনসভাকেও মাঝপথে ভেঙে দেওয়া হবে না। আইনসভা পাঁচ বছরই বৈধ থাকবে। কোনও মন্ত্রিসভার পতন ঘটলে অপেক্ষায় থাকতে হবে যাতে নতুন কোনও মন্ত্রিসভা গঠন করা যায়। তা সম্ভব না হলে রাষ্ট্রপতি শাসন চলবে। এবং এই ভাবে নিশ্চিত করতে হবে যে, এক নির্বাচনের পরে ৫ বছর না কাটা পর্যন্ত লোকসভা বা বিধানসভার জন্য অন্য কোনও নির্বাচন হবে না। শুধু উপনির্বাচন হতে পারে।
যে পন্থাতেই এই নীতি প্রণয়নের চেষ্টা হোক, পথ মোটেই মসৃণ হবে না নরেন্দ্র মোদীর জন্য। রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা তো চালাতেই হবে। অনেকগুলি ক্ষেত্রেই পূর্ণ ঐকমত্যের বা বৃহৎ ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। কারণ সংবিধানের এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংশোধন করা এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রাখা খুব সহজ কাজ নয়। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছেই। বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থানের অত্যন্ত সুক্ষ্ম বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। সেই লক্ষ্যের দিকে কী ভাবে এগোয় সরকার, দেশের নজর আপাতত সে দিকেই থাকবে।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।