ফাইল ছবি
অগ্নিগর্ভ প্রতিবেশী এবং ভূকৌশলগত বলয়ে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত বড় ভরসাস্থল ছিল আরব রাষ্ট্রগুলি। বিজেপি মুখপাত্রের পয়গম্বর সংক্রান্ত মন্তব্যের জেরে তা কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে। কূটনৈতিক শিবিরের মতে, এর প্রভাব শুধু মাত্র পশ্চিম এশিয়ার তেলসমৃদ্ধ দেশগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, আমেরিকা এবং ইউরোপও এ বার বিজেপি শাসনে ভারতের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে আরও বেশি করে আঙুল তোলার সুযোগ পাবে।
কূটনৈতিক মহল মনে করছে এমন সময়ে এই কাণ্ডটি ঘটল, যার কিছু দিন আগে থেকেই সামনের পায়ে এসে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তথা সাউথ ব্লক মানবাধিকার সংক্রান্ত পশ্চিমের একের পর রিপোর্টকে মাছির মতো উড়িয়ে দিয়েছেন। সুযোগ পেলেই ঝাঁঝালো ভাবে পাল্টা আক্রমণ করেছেন। তিন দিন আগেই আমেরিকান কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা সংক্রান্ত একটি রিপোর্টকে তীব্র আক্রমণ করে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানান, ‘এ সবের মধ্যে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।’ এ বারে আরব রাষ্ট্রগুলির ক্ষোভের পরে বিদেশমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, ‘‘আমাদের অতি সপ্রতিভ বিদেশমন্ত্রী তাঁর মুখপাত্রকে দিয়ে ভারতে সংখ্যালঘুদের নিয়ে আমেরিকার সরকারের রিপোর্টকে নস্যাৎ করেছিলেন। পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার বন্ধুরা এ বার জবাব দিচ্ছে।’’ কুয়েত, কাতার এবং ইরানের পরে সোমবারও একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র ভৎর্সনা করেছে বিজেপি সরকার তথা নরেন্দ্র মোদীকে। তাতে স্বভাবতই যোগ দিয়েছে পাকিস্তান, তালিবান এবং ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন)। অন্য কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লি স্বর চড়াতে না পারলেও পাকিস্তান এবং ওআইসি-র বিবৃতির বিরুদ্ধে আজ পাল্টা বিবৃতি দিয়েছেন মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী। যদিও তাতে সম্মিলিত ক্ষোভ নিরসনের কোনও সম্ভাবনাই তৈরি হয়নি।
ওআইসি-র কথায়, ‘মোদী সরকার ক্রমশ সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বাড়িয়ে চলেছে। ভারতে ইসলামকে কদর্য ভাবে আক্রমণ করছে। ধারাবাহিক এবং সুপরিকল্পিত ভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বুনে দেওয়া হচ্ছে।’ বাগচীর কথায়, “আমরা ভারত নিয়ে ওআইসি-র বিবৃতি দেখেছি। ভারত সরকার সার্বিক ভাবে ওই সঙ্কীর্ণমনা, অযাচিত বিবৃতিকে প্রত্যাখ্যান করছে। ভারত সরকার প্রত্যেকটি ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। কিছু ব্যক্তিবিশেষ একজন ধর্মীয় ব্যক্তিকে খাটো করে টুইট করে। ওই মতামত কোনও ভাবেই ভারত সরকারের মতামতের প্রতিফলন নয়। ইতিমধ্যেই ওই মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” এর পর মুখপাত্র বলেন, “এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, ওআইসি সচিবালয় এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অনুচিত এবং বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য করল। এটা তাদের বিভাজনকামী মানসিকতাকেই তুলে ধরছে। বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য এটা করা হল।’’ এমন পড়ে পাওয়া সুযোগ স্বাভাবিক ভাবেই হাতছাড়া করতে চায়নি পাকিস্তান। দীর্ঘদিন পরে এমন একটি ঘটনা ঘটল, যেখানে সমস্ত মুসলিম দেশ ভারতের বিরুদ্ধে একসুর। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এই ঘটনার নিন্দা করার পরে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতের ‘চার্জ দা’ফেয়ার্স’-কে ডেকে পাঠায় পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক। বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘পাকিস্তান সরকার ভারতের শাসক দল বিজেপির দুই পদস্থ কর্তার পয়গম্বর সংক্রান্ত জঘন্য মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করছে। ভারতীয় দূতকে বলা হয়েছে, এই ঘটনা শুধু পাকিস্তানকেই নয়, গোটা বিশ্বের মুসলমান মনকে আহত করেছে।’
পাকিস্তানের এই মন্তব্যের জবাবে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র পাল্টা বলেছেন, “যে দেশের সরকার ধারাবাহিক ভাবে তাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার ভঙ্গ করে, তারা আজ জ্ঞান দিচ্ছে অন্য একটি দেশকে সেই একই বিষয় নিয়ে! ব্যাপারটি এতটাই বিস্ময়ের যে কারও তা নজর এড়াবে না। হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টানদের উপর যে নিপীড়ন পাকিস্তান করে চলেছে, গোটা বিশ্ব তার সাক্ষী। আমরা পাকিস্তানকে তাদের নিজেদের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের দিকে নজর দিতে অনুরোধ করছি। ভারতে সাম্প্রদায়িক অশান্তি তারা যেন তৈরি না করে।”
তবে পাকিস্তানকে দেওয়া এই ঝাঁঝালো উত্তর আদৌ আস্থা অর্জন করতে পারছে না পশ্চিম এশিয়ার, যেখানে প্রায় আশি লাখ ভারতীয় বসবাস করেন। এই ঘটনার তাঁদের উপর কী প্রভাব পড়বে, এ বার সে দিকেও নজর রাখা হচ্ছে। মোদী সরকার নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অসহিষ্ণুতা এবং ইসলাম-বিরোধিতার অভিযোগকে প্রশমিত করতে বারবার এই আরব দেশগুলির সঙ্গে তাদের নৈকট্যের ছবিকে কাজে লাগিয়েছে। ওআইসি-তে পাকিস্তান বা তুরস্ক যত বারই ভারত-বিরোধী অবস্থান নিয়েছে, মোদীর পাশে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো রাষ্ট্র। এমন কোণঠাসা অবস্থায় বিদেশ মন্ত্রক ক্ষত মেরামতির চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনার সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক ঝড় কী ভাবে সামাল দেওয়া যায়, তা এখনও অজানা সাউথ ব্লকের।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।