অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী।
আশ্বাস দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। ভরসা দিতে মুখ খুলেছেন অমিত শাহও। বলছেন, জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-এর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-র। কিন্তু বিরোধী শিবিরের যুক্তি, ২০০৩ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ধারায় বলা রয়েছে, এনপিআর হল এনআরসির প্রথম ধাপ। সরকার মুখে ভরসা দিলেও আইন তো একই রয়েছে। তাঁদের দাবি, আইন যদি না-পাল্টায়, ধরে নিতে হবে, এনপিআর করে ভবিষ্যতে এনআরসি করার দরজা খুলে রাখারই কৌশল
নিয়েছে সরকার।
এনপিআর-এর বিষয়টি প্রথম সামনে আসে ২০০৩ সালে। সেই বছরে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার নাগরিকত্ব আইন (১৯৫৫)-এর একটি ধারায় সংশোধনী আনে। তাতে বলা হয়, ভারত সরকার সব নাগরিকের মাথা গুনে জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার) তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে-সব নাগরিকের নাম এনপিআর তালিকায় থাকবে না, তাঁরা এ দেশের নাগরিক কি না, তা যাচাই করে দেখবে সরকার। যাচাইয়ের পরে নাগরিকত্ব প্রমাণিত হলে নাম উঠবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা সর্বভারতীয় এনআরসি-তে। যেমনটি হয়েছে অসমে (যদিও অসমে এনআরসি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে)। আইনে এটাও বলা হয়েছে, যাঁদের নাম এনআরসি-তে থাকবে, তাঁরাই শেষ পর্যন্ত এ দেশের নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন। তাঁদের নাগরিকত্ব কার্ড দেবে সরকার। ফলে বিরোধীদের দাবি, দু’টির ‘সম্পর্ক নেই’ বলে যে যুক্তি দিচ্ছেন, আইন পরিবর্তন না-হলে সেই যুক্তি খাটে না।
কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘‘সরকার অর্ধসত্য প্রকাশ করছে। বাকিটা পরিকল্পিত ভাবে চেপে রাখা হচ্ছে।’’ তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের মতে, এনপিআর করে এনআরসি-র রাস্তাই খুলে রাখতে চাইছে সরকার। অথচ মুখে বলছে, দু’টির সম্পর্ক নেই। প্রসঙ্গত, ২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (১৯৫৫)-এরই অন্য একটি ধারায় সংশোধনী এনে নয়া নাগরিকত্ব আইন (২০১৯) বা সিএএ তৈরি হয়েছে।
২০০৩ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (১৯৫৫)
প্রথম ধাপ: এনপিআর হবে।
দ্বিতীয় ধাপ: এনপিআর তালিকার ভিত্তিতে হবে নাগরিকত্ব যাচাই।
তৃতীয় ধাপ: নাগরিক প্রমাণে নাম উঠবে এনআরসি-তে। পাওয়া যাবে সিটিজেনশিপ কার্ড।
ঘটনা হল, নাগরিকত্ব আইন ঘিরে বিক্ষোভ দেখে এ-যাত্রায় মোদী-শাহ এনআরসি-র বিষয়টি নিয়ে সুর আপাত মোলায়েম করার কৌশল নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু মোদী সরকারের প্রথম পর্বে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ কিংবা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু একাধিক বার সংসদে ও সংসদের বাইরে দাবি করেছিলেন, এনপিআর হল এনআরসি-র ভিত্তিপ্রস্তর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্টেও একই কথা বলা হয়েছে।
এনপিআর ঘিরে প্রশ্ন রয়েছে আরও। গত কাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে এনপিআর পরিমার্জন খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের বিষয়ে জানাতে এসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর দাবি করেন, এনপিআর-এ যে-তথ্য চাওয়া হবে, তা ঐচ্ছিক। কেউ চাইলে তথ্য না-ও দিতে পারেন। ওই তালিকার সঙ্গে তথ্য দেওয়া না দেওয়ার সম্পর্ক নেই। অথচ ২০০৩ সালের আইনের ওই ধারায় বলা রয়েছে, এনপিআর তালিকার তথ্য দেখে স্থানীয় রেজিস্ট্রারের সন্দেহ হলে তিনি কোনও ব্যক্তিকে সন্দেহজনক নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্রের দাবি, এনপিআর তালিকার ভিত্তিতে কোনও সন্দেহজনক নাগরিকের তালিকা তৈরি হবে না। বিরোধীদের দাবি, যদি তা-ই হয়, তা হলে তা বলুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রসচিব। তাঁদের জানাতে হবে, নিয়মে বদল হয়েছে বা ওই নিয়ম এ ক্ষেত্রে খাটবে না।
এনপিআর-এ ব্যক্তিগত তথ্যের সপক্ষে প্রমাণ দিতে হবে না বলেও দাবি করেছিলেন জাভড়েকর। কিন্তু এনপিআর বিধি বলছে, কোনও পরিবারের প্রধান ভুল তথ্য দিলে এক হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। প্রশ্ন উঠছে, কে সত্যি! প্রকাশ জাভড়েকর নাকি সংসদে পাশ হওয়া আইন? তথ্য যাচাই না-করলে ভুল ধরা হবে কী করে? সরকারের দাবি মোতাবেক যদি কোনও নথি না-ই লাগে, কিসের ভিত্তিতে তথ্য যাচাই হবে? বিরোধীরা বলছেন, রাজনৈতিক স্বার্থে ধোঁয়াশা রাখা হচ্ছে। আর প্রধানমন্ত্রী যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডন করেন, সেখানে প্রকাশের মন্তব্যের মূল্য কী?