এগারো হাজার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেব দীপাবলি পালন হর কি পৌড়ি ঘাটে। বৃহস্পতিবার হরিদ্বারে। নিজস্ব চিত্র।
‘মা গঙ্গার আদেশ’ ছাড়া নাকি হরিদ্বারে একটি প্রদীপও জ্বলে না— এমনই ধারণা হিমালয়ের পাদদেশের এই জনপদে ছড়িয়ে আছে। করোনা আবহে মাস্কহীন হয়ে ভিড়ে ঘুরে বেড়ানোর সময়েও যুক্তিতে সেই ‘মা গঙ্গা’। হর কি পৌড়ি ঘাটের সামান্য আগে রাস্তার ধারে চাটের দোকান মহেশ কুমারের। হাতের কাজ করতে করতে বলে গেলেন, ‘‘মা গঙ্গার কৃপায় এখানে করোনা-টরোনা নেই।’’
বাংলা ক্যালেন্ডারে কার্তিক শেষ হয়ে এখন অগ্রহায়ণ। যদিও হিন্দি ক্যালেন্ডারে বৃহস্পতিবার ছিল কার্তিক পূর্ণিমা ব্রত। গঙ্গার ঘাটে এই তিথিতে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালানো হয়। এর নাম ‘দেব দীপাবলি’। এই দীপাবলি দেখতে হরিদ্বার এখন ভিড়ে ঠাসা। মঙ্গলবার থেকে কাতারে কাতারে লোক আসছে এখানে। এ দিনও সকাল থেকে মোতিবাজার, বড়াবাজার, বিষ্ণু ঘাট, হনুমান ঘাটে লোকের অভাব নেই। হর কি পৌড়ি ঘাটে বিকেলে যখন আরতি শুরু হচ্ছে, সেখানে পা রাখার অবস্থা নেই। জ্বলন্ত প্রদীপ থেকে ঘিয়ের সুবাস ভেসে আসছে কিছুটা দূর পর্যন্ত। সেখানে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, মাস্কহীন এই প্রবল ভিড় ঠেলে কতটা ঢোকা সমীচীন হবে।
এই দৃশ্য মনে মনে করিয়ে দিচ্ছে এ বারে কুম্ভমেলার স্মৃতি। এ বছর এপ্রিলে কুম্ভমেলায় যাবতীয় কোভিড বিধি গঙ্গার জলে ভাসিয়ে লাখ লাখ লোক মিশে গিয়েছিলেন বিশ্বাসীদের ভিড়ে। এবং মেলার অব্যবহিত পরেই বাড়তে শুরু করে দৈনিক করোনা আক্রান্তের লেখচিত্র। মেলার চার দিন পরেই আক্রান্ত হন পুরোহিতরা। তার পর সেই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
দ্বিতীয় ঢেউয়ের সেই আতঙ্ক এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এপ্রিলের পরের দু’টি মাস ভয়াবহ আকার নিয়েছিল করোনা সংক্রমণ। দিকে দিকে অক্সিজেনের অভাবে বাড়ছিল মৃত্যুর সংখ্যা। দেশে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা চার লক্ষের কাছে পৌঁছয়। হাসপাতালে শয্যা চেয়ে হাহাকার এখনও ভুলতে পারেননি সেই সময়ে আক্রান্তদের অনেকেই।
হর কি পৌড়ি ঘাটের দেখাশোনা আয়োজনের দায়িত্ব ‘শ্রীগঙ্গা সভা কমিটি’র। কমিটির প্রচারক নির্দোষ শর্মা বলেন, ‘‘আমরা তো বারবার বলেছি। কিন্তু কেউ শুনলে তো!’’ তাঁর কথায়, ‘‘সারা দেশ থেকে ভক্তরা আসছেন। কেউ করোনা নিয়ে আসছেন কি না কে জানে।’’ আয়োজক, পুরোহিত— অনেকেরই তো মুখে মাস্ক নেই। নির্দোষ বলেন, ‘‘সকলেরই কোভিড বিধি মানা উচিত।’’
সন্ধ্যারতি শেষ হওয়ার পরে ঘাটে প্রদীপ জ্বালানো শুরু হল। হর কি পৌড়ি ঘাটের গঙ্গা মন্দিরের উল্টো দিকের আকাশে তখন রাসের গোটা চাঁদ উঠেছে। শিবালিক পাহাড় মালার মতো আলোয় সেজেছে। গঙ্গার জলে ভাসানো হচ্ছে জ্বলন্ত প্রদীপ। কনকনে হাওয়ায় গঙ্গা স্নান সেরে গায়ে গরম জামা জড়িয়ে নিচ্ছেন পুণ্যার্থীরা।
না, গঙ্গার সেই ঢেউয়ে, বিশ্বাসের ঢেউয়ে কোথাও করোনার চিহ্ন নেই।