নির্মলা বলেছেন এই বাজেটে নাকি যা থাকবে তা গত ১০০ বছরে ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেনি।
নির্বাচনের ডামাডোলে শিরোনাম থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে অর্থনীতি। পুরোটাই বা বলি কী করে। প্রধানমন্ত্রী এখন প্রায় সব অনুষ্ঠানেই টানছেন পশ্চিমবাংলা প্রসঙ্গ। উন্নয়নের সিঁড়িতে রাজ্যের অবস্থান নিয়ে যে আকচাআকচি চলছে তা তো অর্থনীতি বটেই। কিন্তু সে তো রাজনৈতিক স্লোগান। দেশের বড় মঞ্চে কিন্তু বাজারের নীতি নিয়ে দুশ্চিন্তার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।
এই দুশ্চিন্তা আরও ঘন হয়েছে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের আগামী বাজেটে নতুন সংস্কারের দাবি নিয়ে। তিনি বলেছেন এই বাজেটে নাকি যা থাকবে তা গত ১০০ বছরে ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেনি। এক শতাব্দী আগেও আমরা ইংরেজের অধীনে ছিলাম। তাই সংস্কার প্রসঙ্গ বা স্বাধীন দেশের আর্থিক নীতির সঙ্গে সেই তুলনা করাটা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক— কোনও দিক থেকেই বোধহয় ঠিক নয়। আর সংস্কারের প্রতিটি পদক্ষেপই তো ঐতিহাসিক। সংস্কারে মানেই তো পুরনোকে ঝে়ড়ে ফেলে নতুনকে ডেকে আনা! আর তা তো সব সময়েই ঐতিহাসিক!
এবং সংস্কার মানে আইনের পরিমার্জন। গণতান্ত্রিক পরিসরে তা করতে গেলে আইন ও তার অভিঘাত নিয়ে আলোচনাটা জরুরি হয়ে ওঠে। আইন করার পর সেটাই শেষ কথা হয় না। আইন চালু করার পর তার ফাঁকফোকর সামনে আসতে থাকে। আর তখন প্রশ্ন আসে আইনের সংশোধনের। পরিমার্জিত আইন যাঁদের ছুঁয়ে যায়, তাঁদের সুবিধা ও অসুবিধা প্রকট হতে থাকে আইন চালু হওয়ার পর। তাই নিয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে পরে। প্রয়োজনে সংশোধনও করতে হয়।
আরও পড়ুন: ডিসেম্বরে আগত বিদেশফেরত করোনা আক্রান্তদের জিনোম সিয়োকেন্সিং হবে
সরকারকে আপস করতে হয় নাগরিকের দাবির মুখে। আর সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে এখানেই। কারণ, বর্তমান সরকারের নিজের অবস্থান থেকে সরে এসে আপস করে এগনোর প্রবণতা এখনও পর্যন্ত খুব একটা পরিলক্ষিত হয়নি। কিছু বিনিয়োগকারী এতে লাভের সুযোগ দেখলেও, বৃহত্তর সহজ বিনিয়োগের রাস্তা কিন্তু তাতে তৈরি হয় না। ভোডাফোন আর কেয়ার্ন নিয়ে যেমন ভ্রুকুঞ্চনের পরিসর তৈরি হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
অথচ, গণতন্ত্রে ‘গভর্ন্যান্স’ বা শাসনের দক্ষতার যে চারটি মাপকাঠি -- স্বচ্ছতা, মতামত লেনদেন, রূপায়ণের দক্ষতা এবং সততা— তার মধ্যে একটা নড়ে গেলে বাকি সবটাই ভেঙে পড়ে। আর এই ফাঁকফোকর বুজিয়ে আইনকে আরও দক্ষ আর স্বচ্ছ করে তোলার জন্য কিন্তু সব পক্ষের সঙ্গে, বিশেষ করে বিরোধীদের, মতামত যাচাই করা জরুরি। মানে মতামতের লেনদেন। এই প্রক্রিয়ায় ঘুণ ধরলেই কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ তৈরি হয়ে যায়।
উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যাক ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেটের কথা। এই বাজেটে কর প্রস্তাবের একটিও আলোচনার সুযোগ পায়নি। পি আর এস লেজিসলেটিভ রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী ২০০৪-০৫ ও ২০১৩-১৪-র বাজেটেও ব্যয় বরাদ্দের দাবি বিনা আলোচনাতে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সরকার যাদেরই হোক, বিরোধীদের বক্তব্য শোনা ও তার যৌক্তিকতা বিচার করে আপোসই তো গণতন্ত্রের মূল কথা! আর সেখানেই আসে স্বচ্ছতার প্রশ্ন। কৃষি বিলের কথা বহু আলোচিত। কিন্তু এখানেও সেই কোথায় যেন আপসহীন অবস্থান বড় প্রকট।
আরও পড়ুন: সিংঘু সীমান্তে কৃষকদের জন্য ওয়াইফাই বসাবে আপ
অর্থমন্ত্রী বলছেন “বিগ ব্যাং রিফর্ম”-এর প্রয়োজনীয়তার কথা। ১৯৯১ সালের পর থেকে সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবিও কিন্তু হারিয়ে যায়নি আলোচনা থেকে। এমনকী সংস্কারের পুরোহিতরাও এই দাবি মেনে নিলেও, সংস্কারের গতি বড় শ্লথই ছিল। তাই দেশের আর্থিক অগ্রগতির জন্যই প্রয়োজন সংস্কারের। এবং তার অভিমুখ হওয়া উচিত এমন যাতে নিঃসঙ্কোচে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসতে পারেন টাকা ঢালতে। আইনের পরিসরও এমন হওয়া উচিত যাতে বিনিয়োগকারীরা মনে না করেন যে প্রশাসনের ব্যবহারে প্রতিহিংসার বা আপসহীন অবস্থানের পরিচয় রয়েছে।
আর এই জায়গাতেই উঠে এসেছে কেয়ার্ন আর ভোডাফোন প্রসঙ্গ। এই দুটি সংস্থাই বিদেশি বিনিয়োগকারী। এবং এ দুটি-র ক্ষেত্রেই কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে ভারত সরকার আইনি পদক্ষেপ করেছে ইতিহাসের পাতা উল্টে। বিভিন্ন আদালত ঘুরে, শেষে গিয়ে দ্য হেগ-এর আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে মামলাটি ওঠে। এই দুই মামলাতেই সালিশি আদালত বলে, ‘ন্যায়সঙ্গত ও স্বচ্ছ আচরণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে ভারত সরকারের দাবি’।
মাথায় রাখতে হবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতে বিনিয়োগ করায় চুক্তি রক্ষা এবং চুক্তি নিয়ে সালিশির জায়গাকেই বড় অন্তরায় বলে দাবি করে এসেছে। আর প্রধানত এই কারণেই ভারতের এত বড় বাজার থাকা সত্ত্বেও বিদেশি বিনিয়োগের স্রোত এই দেশকে এড়িয়ে বয়েছে। সালিশি আদালতের এই রায়ের পরেও কিন্তু আমরা এই দাবি থেকে নড়তে রাজি নই। কী কারণে আমরা ভোডাফোনের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ থেকে পিছিয়ে আসছি না, তা পরিষ্কার নয়। কিন্তু যেটা পরিষ্কার সেটা হল, সালিশি আদালতের এই বক্তব্য কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগকে নতুন পরিসর তৈরি করে দেবে। বিনিয়োগ টানার মূল কথাটাই হল সরকারি দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি আস্থা। অর্থমন্ত্রী যুগান্তকারী কী সংস্কার আনতে চলেছেন তা বাজেটই বলবে। কিন্তু আপসহীন ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ— এই দুই তকমাই কিন্তু শুধু স্বচ্ছ প্রশাসনিক আচরণের বিরোধী তাই নয়, দেশের ভাবমূর্তিকেও খুব একটা উজ্জ্বল করে না। তাই আগামী বাজেটে কিন্তু অর্থমন্ত্রীর যুগান্তরের আশ্বাসে নজর থাকবে আর্থিক পরিসরে গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ পদক্ষেপের উপরই। এখনও পর্যন্ত যা নিয়ে সংশয় থেকেই গিয়েছে।