শিল্পের হাল ফেরাতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন

বাজেটে ২ কোটি টাকার উপরে আয়-সম্পন্ন অতি-ধনীদের আয়করের উপরে সারচার্জ বসানোয় শিল্পমহল চটেছিল। অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিলেন, এখন না হলেও স্বাধীনতার ৭৫ বছরে, অর্থাৎ ২০২২-এ ধনীদের আয়করে সারচার্জের পর্যালোচনা হবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৯ ০২:৫২
Share:

সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ছবি: পিটিআই।

অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বাজেটের আগে শিল্পমহল যে সব দাবি করেছিল, বাজেটের প্রায় দেড় মাস পরে সে সব পদক্ষেপ ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। শেয়ার বাজারে বিদেশি সংস্থার লগ্নি থেকে আয়ের উপর বাড়তি সারচার্জ বসানোর মতো যে সিদ্ধান্ত বাজেটে নিয়েছিলেন, তা-ও ফিরিয়ে নিলেন। জানালেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে তাল রেখে ব্যাঙ্কগুলিও গাড়ি-বাড়ি, শিল্পের ঋণে সুদের হার কমাবে। ঋণের অভাব মেটাতে ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নগদের অভাব মেটানো হবে।

Advertisement

বাজেটে ২ কোটি টাকার উপরে আয়-সম্পন্ন অতি-ধনীদের আয়করের উপরে সারচার্জ বসানোয় শিল্পমহল চটেছিল। অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিলেন, এখন না হলেও স্বাধীনতার ৭৫ বছরে, অর্থাৎ ২০২২-এ ধনীদের আয়করে সারচার্জের পর্যালোচনা হবে। বাজেটে গাড়ি শিল্পের জন্য ত্রাণের ঘোষণা না করলেও এখন সেই গাড়ি শিল্পের জন্য ত্রাণের ঘোষণা করে আশ্বাস দিলেন, আগামী সপ্তাহে আবাসন শিল্পের জন্যও কিছু পদক্ষেপ করা হবে।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই অভিযোগ, অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়ছে। বাজারে বিক্রিবাটা নেই। লগ্নি নেই। আর্থিক বৃদ্ধির হারও কমতির দিকে। গাড়ি শিল্প জানিয়েছিল, বিক্রি কমে যাওয়ায় ১০ লক্ষের বেশি মানুষের চাকরি যেতে বসেছে! শিল্পপতিদের দাবি ছিল, মানুষ পাঁচ টাকা দামের বিস্কুটের প্যাকেট কিনতেও ইতস্তত করছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বাড়ছে, দাবি অমিতের

মোদী সরকারের অন্দরমহলে নীতি আয়োগের উপাধ্যক্ষ রাজীব কুমারও বলে ফেলেছিলেন, ‘আর্থিক ক্ষেত্রে এমন সঙ্কট অভূতপূর্ব, যা গত ৭০ বছরে দেখা যায়নি’। যদিও পরে তিনি সংবাদমাধ্যমকে দায়ী করে বলেন, এমন কথা তিনি বলেননি। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রথীন রায়, শমীকা রবিরাও বলছিলেন, অর্থনীতির হাল ফেরাতে কাঠামোগত সংস্কার দরকার।

ঘরে-বাইরে এই চাপের মুখেই আজ অর্থমন্ত্রী শিল্পমহলের দাবি মেনে একগুচ্ছ পদক্ষেপ ঘোষণা করে মেনে নিলেন যে, অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়েছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, নতুন লগ্নির রাস্তা তৈরি করতে শিল্পমহল ১ লক্ষ কোটি টাকার দাওয়াই বা ‘স্টিমুলাস’ চেয়েছিল। রাজকোষের টানাটানির কথা মাথায় রেখে সে পথে না গেলেও আজ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শিল্পমহলের চাপের সামনে মাথা নোয়ালেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এতে কি অর্থনীতি চাঙ্গা হবে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বেসরকারি লগ্নিতে যে ‘অ্যানিম্যাল স্পিরিট’ ফেরানোর কথা বলেছেন, তা কি ফিরে আসবে? বিভিন্ন শিল্পে যে রুজিরোজগার হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা কি আটকানো যাবে? ইতিমধ্যেই যে সব চাকরি গিয়েছে, তা কি আবার ফিরে আসবে?

অর্থমন্ত্রী জোর গলায় এমন দাবি করেননি। বলেছেন, এই সব সমস্যার সমাধানেই আজকের পদক্ষেপ ঘোষণা হল। তিনি বলেন, ‘‘শিল্পমহল, ব্যাঙ্ক, অন্যান্য অংশীদারেরা এই সব দাবি করেছিলেন। আমরা নর্থ ব্লকে বসে কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি।’’ তবে তাঁর দাবি, বিশ্ববাজারেই চাহিদা খুব কম। তা সত্ত্বেও অধিকাংশ বড় অর্থনীতির তুলনায় ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার বেশি। কেন দেরিতে এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, বাজেটেই কেন ঘোষণা হল না, তার জবাব দেননি নির্মলা। বাজারে যখন চাহিদা নেই, তখন শিল্পমহলের নানা দাবি মেনে নেওয়ার পরে তারা লগ্নি করতে শুরু করবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে।

আজ কর্পোরেট সংস্থার সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে খরচের নিয়ম ভাঙায় ফৌজদারি অপরাধের নিদান তুলে নেওয়ার ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। আয়কর দফতরের হেনস্থা রুখতে ঘোষণা করেছেন, সব নোটিস কেন্দ্রীয় স্তর থেকে পাঠানো হবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের লগ্নি বা এফপিআই-তে সারচার্জ বসায় শেয়ার বাজারে ধস নেমেছিল। বাজার থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছিল এই সংস্থাগুলি। তা প্রত্যাহারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি মূলধনী আয়ে বাড়তি সারচার্জ প্রত্যাহারের ঘোষণা করেছেন। স্টার্ট-আপে লগ্নিকারীদের উপর কর বা ‘অ্যাঞ্জেল ট্যাক্স’-ও প্রত্যাহারের ঘোষণা করেছেন। সরকারের ঘরে ছোট-মাঝারি শিল্পের পাওনা, জিএসটি বাবদ রিফান্ড দ্রুত মেটানো হবে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে যাতে খরচ না আটকে থাকে, তার জন্য ক্যাবিনেট সচিব স্তর থেকে নজর রাখা হবে। দেশীয় সংস্থার পুঁজির অভাব
বিদেশ থেকে পূরণ করতে ২০১৪-য় ঘোষিত ‘ডিপোজিটরি রিসিপ্ট স্কিম’ চালু করা হবে।

কিন্তু শিল্পমহলের এক লক্ষ কোটি টাকার দাওয়াই বা ‘স্টিমুলাস’ মেনে না নিলে কি সুফল মিলবে? মোদীর ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির লক্ষ্যে কি পৌঁছনো যাবে?

এক নজরে

• ভারতীয় ও এক শ্রেণির বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থার (এফপিআই) শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মূলধনী লাভকরে বসানো সারচার্জ প্রত্যাহার।

• করদাতার হেনস্থা কমাতে আয়কর নোটিস পাঠানোর ব্যবস্থায় বদল।

• জিএসটিতে আগে মেটানো কর ফেরতের ব্যবস্থা সহজ করা।

• রেপো রেট কমানোর সুবিধা আরও বেশি করে সাধারণ মানুষকে দেবে ব্যাঙ্কগুলি।

• গাড়ি শিল্পকে চাঙ্গা করতে একগুচ্ছ ঘোষণা।

• বাজারে পুঁজি জোগাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে অবিলম্বে ৭০,০০০ কোটি টাকা।

অর্থসচিব রাজীব কুমার বলেন, ‘‘আমরা আরও পদক্ষেপ ঘোষণা করতে থাকব। ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করা, ঋণের জন্য নগদ অর্থ জোগান তারই জন্য।’’ আর্থিক বিষয়ক সচিব অতনু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘স্টিমুলাস বসলে সকলেই কর ছাড়, আর্থিক উপহার ভাবেন। আজ কাঠামোগত সংস্কারের চেষ্টা হয়েছে। ব্যাঙ্ক থেকে এনবিএফসি হয়ে ঋণের জোগানের যে পাইপ ভেঙে গিয়েছিল, তা মেরামত করা হয়েছে। ঋণের জোগান বাড়ানো, সুদের হার কমানো, পুঁজির জন্য অর্থের বন্দোবস্ত, শেয়ার বাজারে লগ্নির জোগান— সে দিকে তাকিয়েই আজকের পদক্ষেপ।’’

প্রশ্ন উঠেছিল, অর্থনীতি হঠাৎ ঝিমিয়ে পড়ল কেন? মোদী সরকারের নোট বাতিল ও ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি-র ধাক্কা? অর্থমন্ত্রী জবাব দেননি। প্রশ্ন শুনে শুধু বলেছেন, ‘‘ধন্যবাদ।’’

কংগ্রেস ঠিক এই জায়গাটিকেই নিশানা করে আক্রমণে নেমেছে। মণীশ তিওয়ারির কথায়, ‘‘একদিকে নোটবন্দি এবং জিএসটি-র ধাক্কা, অন্য দিকে সৎ ব্যবসায়ীদেরও সন্ত্রস্ত করে রাখা— এই জোড়া সমস্যায় অর্থনীতির ভিত্তিভূমি দুর্বল হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এনডিএ/বিজেপির অর্থমন্ত্রীদের অর্থনৈতিক বিষয় বুঝে ওঠার অক্ষমতা।’’

প্রসঙ্গত, আগামী ৬ সেপ্টেম্বর একটি বণিকসভার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতা যাচ্ছেন নির্মলা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement