প্রতীকী ছবি।
ফেসবুকের সঙ্গে গোপন আঁতাঁতের জন্য বিজেপিকে বিঁধছে কংগ্রেস। দক্ষিণপন্থীদের লেখা ‘চেপে দেওয়া’ আর ‘বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতের’ সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগে ওই মার্কিন বহুজাতিকের কর্ণধারকে চিঠি পাঠাচ্ছেন কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী। আবার নিজেদের মর্জিমাফিক লেখা-ছবি-ভিডিয়ো পেজ থেকে সরিয়ে দিতে নতুন নিয়মের নোটিস ঝোলাচ্ছে ফেসবুক। সব মিলিয়ে, টানটান রাজনৈতিক থ্রিলার হয়ে ওঠার পথে মোড় নিচ্ছে ফেসবুক-নাটক!
গত মাসে দু’সপ্তাহের ব্যবধানে দু’বার ফেসবুকের সঙ্গে বিজেপির ‘আঁতাঁতের খবর’ নামী মার্কিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ দিন সে বিষয়ে ফের কিছু নতুন তথ্য সামনে আসতেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর টুইট, “ভারতের গণতন্ত্র এবং সামাজিক একতাকে নষ্ট করতে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের আক্রমণ ফাঁস হয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।…এ নিয়ে অবিলম্বে তদন্ত হোক। শাস্তি হোক দোষীদের।” এর সঙ্গে রাহুল জুড়ে দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত দু’টি খবর। যার একটিতে ফেসবুকের ভারতীয় কর্তা দাবি করছেন, ২০১৪ সালের ভোটের আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় নরেন্দ্র মোদীর প্রচারে ঝড় তুলেছিলেন তাঁরা। আর অন্যটিতে বলা হয়েছে ২০১২ সালে গুজরাতে বিধানসভা ভোটের আগে ফেসবুক পেজে ১০ লক্ষ সমর্থক জোগাড়ের লক্ষ্যমাত্রার কথা।
কংগ্রেসের অভিযোগ, অনলাইন কেনাকাটার বাজারে টাকা মেটানোর মাধ্যম হয়ে উঠতে চায় ফেসবুকের শাখা হোয়াটসঅ্যাপ। তার জন্য মোদী সরকারের অনুমোদন পেতে যে তারা শাসক দলের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়ার পথে হাঁটছে, তা আগেই উঠে এসেছে নামী মার্কিন সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু এখন তার সঙ্গে আরও জানা যাচ্ছে যে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে সমালোচনাকারী ৪৪টি ফেসবুক পেজের নাম তুলে ধরেছিল বিজেপি। তার মধ্যে ১৪টিকে (৩২%) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ ফিরে এসেছে বিজেপির প্রচারে সহায়ক ১৭টি পেজ! এ জন্য বিজেপির সঙ্গে ফেসবুকের অন্যতম ভারতীয় কর্তা আঁখি দাস ও শিবনাথ ঠুকরালের আঁতাতের দিকে যেমন আঙুল তোলা হয়েছে, তেমনই প্রশ্ন উঠছে বিজ্ঞাপনের বিষয়ে।
এ দিনই আবার উল্টে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ তুলে ফেসবুক কর্ণধার মার্ক জ়াকারবার্গকে চিঠি দিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। বক্তব্য, দক্ষিণপন্থীদের লেখা চেপে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে তাদের। লেখা-ছবি-ভিডিয়োর সত্যতা যাচাইয়ের পদ্ধতি শিথিল। তার উপরে সংস্থার শীর্ষ ভারতীয় কর্তারা যে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, তারা গোহারা হেরেছে গত কয়েকটি ভোটে! প্রসাদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী এবং ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের খারাপ ভাষায় আক্রমণ করেছেন ফেসবুকের ভারতীয় শাখার কর্তারা।মন্ত্রীর এই চিঠির পরেই কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার দাবি, “মোদী সরকারের যদি এক ফোঁটা বিশ্বাসযোগ্যতাও আর বাকি থাকে, তবে ফেসবুক-ইন্ডিয়া এবং বিজেপির আঁতাঁতের বিষয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্তে আপত্তি কোথায়?...কোথায় সেই ৫৬ ইঞ্চির ছাতি?”
এই রাজনৈতিক যুদ্ধের মধ্যেই আবার নিয়ম বদলেছে ফেসবুক। সেখানে স্পষ্ট লেখা হয়েছে, আগামী ১ অক্টোবর থেকে কোনও তথ্য, লেখা-ছবি-ভিডিয়ো (কনটেন্ট) কিংবা পরিষেবা তাদের আইনি ভাবে বিপাকে ফেলতে পারে কিংবা নিয়ন্ত্রকের চক্ষুশূল করতে পারে বলে মনে করলে, গ্রাহককে না-বলেই তা সরিয়ে দিতে পারবে তারা। আটকে দিতে পারবে তাতে গ্রাহকের হাত দেওয়াও। আর এতেই শোরগোল পড়েছে সারা বিশ্বে।
এক পক্ষের বক্তব্য, ধর্মীয়, সন্ত্রাসবাদী, গোষ্ঠী সংঘর্ষে প্ররোচনামূলক লেখালেখির কারণে ফেসবুককে দুনিয়া জুড়ে অসংখ্য মামলা সামলাতে হয়। এত দেশের এত আইনে এত মামলা লড়তে বিস্তর খরচ তো হয়ই, সেই সঙ্গে বিপুল সময় নষ্ট হয়। সেই সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পেতে এই নিয়ম সম্ভবত খুশিই করবে ফেসবুকের শেয়ারহোল্ডারদের।
উল্টো দিকে প্রশ্ন, গ্রাহককে না-বলে তাঁর তথ্যে হাত দেওয়ার স্বাধীনতা সংস্থা নিজের হাতে নিলে তা আর মতের আদান-প্রদানের খোলা জায়গা রইল কোথায়? তা ছাড়া, কোনটি ভাল বা খারাপ, তার বিচার যে ফেসবুক ঠিক করছে কিংবা সেই বিচারে যে সংস্থা পক্ষপাতশূন্য, তারই বা নিশ্চয়তা দেবে কে?
সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞ পরাঞ্জয় গুহঠাকুরতার কথায়, “এই নিয়মের ব্যাখ্যা এখনও স্পষ্ট নয়। এর মাধ্যমে সংঘর্ষে উস্কানিমূলক মন্তব্য, অশ্লীল ছবি ইত্যাদি আটকানো হলে, তা এক রকম। কিন্তু ভাল-খারাপ বিষয়টি একেবারেই আপেক্ষিক। গ্রাহকের মতামতকে থোড়াই কেয়ার করে একতরফা ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া তাই বিপজ্জনক। ধরা যাক, ফেসবুকের সমালোচনা করার একটি অনুষ্ঠান ওই সোশ্যাল মিডিয়াতেই লাইভ দেখানো তারা এই নিয়মেই আটকে দিতে পারবে কি? কিংবা এমন হবে না তো যে, এক জনের বিষয় ব্রাত্য অথচ অন্য জনের ক্ষেত্রে সাত খুন মাফ?” উল্লেখ্য, এই আঁতাঁত নিয়ে বুধবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির যে বৈঠকে ফেসবুক কর্তাদের ডেকে পাঠানো হয়েছে, সেখানেও বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত থাকবেন তিনি।