সংসদে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সনিয়া গান্ধী, কংগ্রেসের লোকসভা এবং রাজ্যসভার দুই নেতা অধীর চৌধুরী ও মল্লিকার্জুন খড়্গে। ছবি: পিটিআই।
জি২০-র পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে বিজেপি। আর দেশে নির্বাচনের মরসুম শুরু হওয়ার ঠিক আগে ‘বিশ্বগুরু’র পাশাপাশি মোদী নিজে সংসদের নতুন ভবনকে সামনে রেখে রাষ্ট্রনেতা বা ‘রাষ্ট্রগুরু’ মর্যাদার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। রাজনৈতিক স্তরে অনেকেই এমনটা মনে করছেন। রাজ্যসভার অধিবেশনে আজ কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে ও কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীর চৌধুরী সেন্ট্রাল হলে দেওয়া বক্তৃতায় সেই ভাবমূর্তিকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন। সব মিলিয়ে নতুন ভবনে অধিবেশনের প্রথম দিন থেকেই মোদীর ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা ও কংগ্রেসের পাল্টা জবাবে রাজনৈতিক শিবির বুঝে গিয়েছে— ভবন বদল হলেও, সংসদ আছে সংসদেই!
গত কাল থেকে আজ দেড় দিনের মধ্যে সংসদে মোট চারটি দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যে তিনটি আজকেই (সেন্ট্রাল হল, লোকসভা এবং রাজ্যসভায়)। বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উনিশ-বিশ। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে স্মরণ, রাজদণ্ড সেঙ্গোলের উল্লেখ, দল নির্বিশেষে পূর্বজদের শ্রদ্ধা— যা নাকি তাঁর মুখে সচরাচর শোনা যায় না। তবে তার মাঝে খোঁচাও দিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধীর উদ্দেশে।
অনেকেই বলছেন, বাদল অধিবেশনে মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দু’কথা বলাতে বিরোধী পক্ষকে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হয়েছিল। আবেদন, অনুনয়, হট্টগোল, স্লোগান, প্ল্যাকার্ড, ধর্নায় কোনও কাজ হয়নি। সেই তিনিই এক দিনে তিনটি বক্তৃতা দিলেন সংসদে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বক্তৃতাগুলিতে মণিপুর, মূল্যবৃদ্ধি বা বেকারত্বের মতো সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সঙ্কটের কোনও দিশাই দেখাননি মোদী। তিনি শুধু ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে নিজেকে জুড়ে নিজের ভাবমূর্তিকে রাষ্ট্রনেতা বা রাষ্ট্রগুরুর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। সেন্ট্রাল হলে দেওয়া বক্তৃতায় মোদী বলেন, “আমি লালকেল্লা থেকে বলেছিলাম— এটাই উপযুক্ত সময়। একের পর এক ঘটনা সেটাই প্রমাণ করছে। ভারত নতুন চেতনা নিয়ে জেগে উঠেছে।” লোকসভায় তাঁকে বলতে শোনা যায়, “এই ভবন নতুন, কিন্তু ঐতিহ্য পুরনো। গতকাল আর আজ মিলে তৈরি হয়েছে ঐতিহ্য। সংসদীয় গণতন্ত্রে স্বাধীনতার প্রথম আলো সেঙ্গোলের উপর পড়েছে। এই সেঙ্গোল দেশকে সংযুক্ত করার প্রতীক। এই পবিত্র সেঙ্গোল— যা জওহরলাল নেহরুর হাতে শোভা পেত, তা আমাদের প্রেরণা।”
আজ রাজ্যসভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। লোকসভা, রাজ্যসভা, সেন্ট্রাল হলে। তিনটি বক্তৃতা হয়ে গেল আজই! উনি অবশ্য কোনও বিষয়ে বিরোধীদের কৃতিত্ব দিতে চান না। কিন্তু সবই নিজের ঝোলায় পুরে ফেলার চেষ্টা ভাল নয়। প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলছেন উনি নাকি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মজবুত করেছেন। কিন্তু আমি বলব, আপনার সময়ে এই কাঠামো প্রতিদিন দুর্বল হচ্ছে। এখানে উপস্থিত সবাই এ কথাই বলবে। আপনারা বকেয়া টাকা দিচ্ছেন না। জিএসটি হোক বা একশো দিনের কাজ। পশ্চিমবঙ্গ মহারাষ্ট্র, কর্নাটক— সর্বত্র একই ছবি।” মোদীকে নিশানা করে খড়্গের মন্তব্য, “বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচিত সরকারগুলি আপনারাই ফেলেছেন। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, মণিপুর— সর্বত্র এক ঘটনা। আপনি বলেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখেন, তাকে মজবুত করতে চান। এখন যাকে ‘সংবিধান সদন’ নাম দিচ্ছেন— সেটির গোড়ার সময়ে বিজেপির কোনও ভূমিকাই ছিল না দু’একজন বড় নেতা ছাড়া। একদিনেই প্রধানমন্ত্রীর তিনটে বক্তৃতা হয়ে গেল, কিন্তু তিনি মণিপুর নিয়ে একটি কথাও বললেন না। উনি আজ অধিবেশন কক্ষে এসেছেন। মোদী এলে তাঁর হয়ে জোর গলায় কে বলতে পারে, বিজেপিতে সেই প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। তবে আপনি একটু সতর্ক থাকবেন— কে সামনে বলছে আর পিছনে কে বলছে!”
মোদী আজ ২০৪৭-এর মধ্যে ভারতকে ‘বিকশিত দেশ’-এ পরিণত করার ডাক দিয়েছেন। বিষয়টি নতুন নয়, গত দু বছরে বারবার একই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আজ মোদী বলেন, “ ভারত এখন পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু দেশ যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এখানে অনেকেই সেটা বিশ্বাস না করতে পারেন কিন্তু গোটা বিশ্ব ভারতের উত্থান নিয়ে আস্থাশীল।”
পরে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী সেন্ট্রাল হলের বক্তৃতায় বলেন, “২০৪৭-এ পৌঁছে বিকশিত ভারতের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু উন্নত দেশ আসলে কী— তার কোনও সংজ্ঞা নেই। যাকে আসল মাপকাঠি হিসাবে ধরা যায়, তা হল মানব উন্নয়ন। এই মানব উন্নয়নে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমরা পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হলেও মাথাপিছু আয়ে অনেক পিছিয়ে। দেশে দশ শতাংশের হাতে ৭৩ শতাংশ সম্পদ। এই পরিস্থিতি হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে।” কেন্দ্রীয়মন্ত্রী পীযূষ গয়াল অধীরকে পাল্টা খোঁচা দিয়ে বলেন, “স্বাধীনতার পর যদি সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা হত, তাহলে আরও আগে আমরা উন্নত দেশ হতে পারতাম।”
মোদীর বক্তৃতায় বারবার সংবিধানের উল্লেখ রয়েছে। খড়্গে পরে বলেন, “বাবাসাহেব অম্বেডকর বলেছিলেন, সংবিধান যত ভালই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সেটা যাঁরা কার্যকর করবেন, তাঁদের উপর নির্ভর করছে তা ভাল না খারাপ।” অম্বেডকরের উক্তিটি রাজ্যসভায় তিন বার উল্লেখ করেন খড়্গে।