ছবি: এপি।
আপাতত প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে (আরসিইপি) সই করার প্রশ্নই নেই। উল্টে ঘরে-বাইরে প্রবল চাপের মুখে আরও এক ধাপ এগিয়ে মনমোহন সিংহের জমানায় হওয়া বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তি ফের খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিল কেন্দ্র। ‘কথা দিল’, কখনও তাড়াহুড়োর বশে এই পথে পা না-বাড়ানোরও।
মঙ্গলবার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল জানালেন, আরসিইপি থেকে সরে আসার পরে এ বার আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে হওয়া বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তি খতিয়ে দেখবেন তাঁরা। দেখা হবে জাপান, কোরিয়া এবং দশ দেশের (ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি) আসিয়ান গোষ্ঠীর সঙ্গে আগেই হয়ে থাকা অবাধ বাণিজ্য চুক্তিও।
মন্ত্রীর দাবি, শুধু ওই সমস্ত বাণিজ্য চুক্তির কারণে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১,১০০%! ৭০০ কোটি ডলার থেকে তা বেড়ে হয়েছে ৭,৮০০ কোটি ডলার। সেই কারণেই এই খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত বলে তাঁর দাবি। প্রশ্ন উঠছে, এ ভাবে অতি রক্ষণশীল নীতি আঁকড়ে ধরলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত কল্কে পাবে কি? তখন ভারতীয় পণ্যের জন্য বাজার খুলতে আগ্রহী হবে কোন দেশ? ভারতকে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি করে তুলতে ১ লক্ষ কোটি ডলার রফতানি লক্ষ্যের কথা বার বার বলেন প্রধানমন্ত্রী। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পেও ফেরি করা হয় এ দেশে তৈরি পণ্য সারা বিশ্বে বিক্রি করার কথা। বাকি বিশ্বের থেকে এ ভাবে বিচ্ছিন্ন হলে সেই বাজারের চাবি কী ভাবে হাতে থাকবে, প্রশ্ন তা নিয়ে।
চিন্তা ছিল...
• আরসিইপি-র ১৫টি দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ১০,৫০০ কোটি ডলার। শুধু চিনের সঙ্গে প্রায় ৫,৪০০ কোটি। চুক্তি হলে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা
• বাজার ছেয়ে যাবে সস্তার চিনা পণ্যে। অন্য দেশ ঘুরেও তা ঢুকবে ভারতে।
• ভিয়েতনাম-সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কৃষিপণ্যের লড়াইয়ে এঁটে ওঠা শক্ত।
• দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে নিউজ়িল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন।
• অর্থনীতি ঝিমিয়ে। তার উপরে সস্তার বিদেশি কৃষি ও শিল্প পণ্য বাজার দখল করলে মাথায় হাত পড়বে চাষি, ছোট শিল্প ও ব্যবসায়ীদের।
ভারত চেয়েও পায়নি...
• জলের দরে (মূলত চিনা) পণ্য ঢোকা রুখতে বন্দোবস্ত। এমনকি তা অন্য দেশ ঘুরে এলেও।
• বিদেশি পণ্য আসা নির্দিষ্ট সীমা ছাড়ালেই আমদানি শুল্ক চাপানোর বিধি।
• শুল্ক মাপার ভিত্তি বর্ষ ২০১৯। বাকিরা চেয়েছিল ২০১৪। চুক্তি সই করলে ভারতকে আরও বেশি আমদানি শুল্ক কমাতে হত।
• আমদানি রুখতে চড়া কর ছাড়াও অন্য সব বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার), কমানোর প্রতিশ্রুতি।
• পরিষেবা বাণিজ্যেও সমান গুরুত্ব। যাতে ভারতের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার জন্য বেশি করে দরজা খোলে ১৫টি দেশ।
• কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্যকে বাড়তি সুবিধা।
বাজার ছেয়ে ফেলা সস্তার চিনা পণ্যের সঙ্গে দামের লড়াইয়ে নাভিশ্বাস উঠছে ছোট শিল্প ও ব্যবসায়ীদের। চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৫,৪০০ কোটি ডলার। সস্তা ইস্পাত থেকে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন পণ্য হয়ে দীপাবলির এলইডি আলো— বহু বিষয়েই ভারতের বাজারে বড় ভাগ বসিয়েছে চিন। আরসিইপি-র হাত ধরে সেই দরজা আরও খুলে গেলে মাথায় হাত পড়বে তাঁদের। বিশেষত দেশের বাজারে যখন চাহিদা বাড়ন্ত। বিরোধীদের আক্রমণ, সঙ্ঘের শাখা স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের আপত্তির সামনে মূলত এই আশঙ্কা তুলেই আপাতত ওই চুক্তি সই থেকে পিছিয়ে এসেছে মোদী সরকার।
আরও পড়ুন: দৈনিক ৯ ঘণ্টা কাজ? অসন্তোষ খসড়া বিধি ঘিরে
বিক্ষোভ এবং আপত্তি ছিল কৃষক, গোয়ালা, এমনকি আমূলের মতো দুগ্ধ সমবায় সংস্থারও। কাল দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখানো সর্ব ভারতীয় কৃষি সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির যুক্তি, এ দেশের চাষিদের মাথায় ঋণের বিপুল বোঝা। চাষের খরচ বেশি। পরিকাঠামো অপ্রতুল। সেচ নামমাত্র। এই পরিস্থিতিতে সামান্য লাভের মুখ দেখতেও নাজেহাল চাষিরা। তার উপরে বাইরের সস্তার কৃষি পণ্যের সঙ্গে তাঁরা এঁটে উঠবেন কী ভাবে? ইইউ এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির পরে চা, কফি, এলাচ ইত্যাদি চাষে ব্যাপক মার খাচ্ছেন তাঁরা।
দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত শিল্পের দাবি, নিজেদের ৯৩% দুধ, ৯৪% মাখন, ৮৬% চিজ রফতানি করে নিউজ়িল্যান্ড। তারা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ জলের দরে দুগ্ধজাত পণ্য ভারতের বাজারে আনলে, কী ভাবে টিকে থাকবে দেশীয় শিল্প? শিল্পমহল, চাষি, বিরোধীদের পাশাপাশি গোড়া থেকে আপত্তি তুলেছে সঙ্ঘের শাখা স্বদেশি জাগরণ মঞ্চও। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে মোদীর সরে আসার পিছনে সঙ্ঘের ছায়া দেখছেন অনেকে।
চিনের আশ্বাস, ভারতের তোলা সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করবে তারা। ভারতকে বাদ দিয়েই এই চুক্তি নিয়ে এগোনোর কথাও ভাবছে তারা। পীযূষের দাবি, বাণিজ্য ঘাটতি মাত্রাছাড়া হওয়া রুখতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। ঘটনা হল, এক দিকে সঙ্ঘের ‘স্বদেশি চাপ’, অন্য দিকে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার ভোটে গ্রামে ধাক্কা। এই জোড়া চাপে বাণিজ্য চুক্তিতে আপাতত ‘ধীরে চলো’ নীতির পক্ষে মোদী সরকার।