নিজে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে পারেননি। কিন্তু ইচ্ছে ছিল পড়াশোনার ক্ষেত্রে কাজে লাগে, এ রকম কিছু করবেন। সেই স্বপ্ন পূর্ণ করেছেন কেরলের ৮৩ বছর বয়সি স্কুলছুট বৃদ্ধ, শ্রীধরণ। ২৫ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তৈরি করেছেন অভিধান। চারটি ভাষার প্রতিশব্দ রয়েছে সেখানে।
তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়লম—দক্ষিণ ভারতের মূল এই চারটি ভাষার ১২ লক্ষ ৫০ হাজার শব্দ আছে এই অভিধানে। অর্থাৎ মালয়লম ভাষায় প্রতিটি শব্দের প্রতিশব্দ তামিল, তেলুগু এবং কন্নড়ে কী কী হবে, তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি।
কেরলের থেলাসরির বাসিন্দা শ্রীধরণ চতুর্থ শ্রেণির পরেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ভাষা ও শব্দের প্রতি আকর্ষণ রয়েই গিয়েছিল মনের মধ্যে।
স্কুল ছাড়ার পরে তিনি কাজ নেন স্থানীয় একটি বিড়ি কারখানায়। কিন্তু প্রাইভেটে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। নিজের চেষ্টায় প্রাইভেটে পড়াশোনা করে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হন। এর পর চাকরি পান সরকারি দফতরে।
১৯৮৪ থেকে তিনি অভিধান সংকলনের কাজ শুরু করেন। তবে পুরোপুরি মন দিতে পেরেছিলেন আরও ১০ বছর পার করে, চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরে। সারা দিন শব্দ ও প্রতিশব্দ অনুসন্ধান করতেন তিনি। এতেই সব থেকে বেশি আনন্দ ও তৃপ্তি ছিল তাঁর।
নিজের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য পায়ে হেঁটে ঘুরতেন দূরে দূরান্তরে। আলাপ করতেন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে। চেষ্টা করতেন বেশি করে স্থানীয় শব্দ সংগ্রহের।
তাঁর কাজের কথা জানতে পেরে অনেকে নিজে থেকে এগিয়ে এসে এসে সাহায্য করেছেন নতুন নতুন শব্দ ও তাদের প্রতিশব্দ দিয়ে।
কাজ নিখুঁত করার জন্য চেষ্টার কসুর করতেন না তিনি। জানিয়েছেন, মালয়লম শব্দ ‘ভয়ম্বু’-র তেলুগু প্রতিশব্দ খুঁজে পেতে তাঁর দীর্ঘ ৬ বছর সময় লেগেছিল।
শব্দের খেলায় পাগল শ্রীধরণ রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেও নাকি নতুন নতুন শব্দ খুঁজে পেতেন। ঘুম ভেঙে তখন বসে পড়তেন অভিধান লেখার কাজে।
কোনও আর্থিক সাহায্য বা অনুদান ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এই কাজ করে গিয়েছেন শ্রীধরণ। শত প্রতিকূলতার মুখেও হার মানেননি।
অভিধান লেখার পরে পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঘুরেছেন প্রকাশকদের দরজায় দরজায়। কিন্তু কেউ তাঁর বই ছাপানোর আগ্রহ দেখাননি।
শ্রীধরণের সংগ্রাম প্রকাশ্যে আসে এক তথ্যচিত্র পরিচালকের সৌজন্যে। নন্দন নামে ওই পরিচালক তাঁর তথ্যচিত্রে তুলে ধরেন শ্রীধরণের জীবন ও কাজ।
শেষে ২০২০-র নভেম্বরে প্রকাশিত হয় শ্রীধরণের বই। কেরলের প্রবীণ নাগরিকদের একটি সংস্থা এই বই মুদ্রণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে।
নিজের লেখা ৯০০ পৃষ্ঠার অভিধানের মুদ্রিত রূপ দেখে শ্রীধরণের স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। তাঁর জীবনের উপর তৈরি তথ্যচিত্রটিও প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে।
শ্রীধরণের এই নিষ্ঠা মনে করিয়ে দেয় আর এক বঙ্গজ ভাষাবিদকে। তিনি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিপ্রায়ে তিনি ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সংকলিত করেন। ১৯০৫ থেকে ১৯৪৫— দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে তিনি এই কাজ করেছিলেন। বাংলা ভাষার কল্যাণের জন্য নিজের প্রায় পুরো জীবনই উৎসর্গ করেছিলেন এই সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক।