মা মেয়ের মিলনের সেই মুহূর্ত। ছবি অঞ্জলি পওয়ারের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
নির্মলা মিশ্রর গাওয়া তোতাপাখির গান ইন্দু জানেন না। তবু ইন্দুর ডাকে সাড়া দিয়েছে অদৃশ্য তোতাপাখি। ভারতের উত্তর-পূর্বের এক শহরতলি থেকে তোতাপাখিই যেন খুঁজে দিয়ে গেছে ইন্দুর মাকে।
বৃহস্পতিবার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে চোখের জল বাঁধ মানছিল না দু’জনের। কেউ কারও ভাষা বোঝেন না। চোখের জলই ধুয়ে দিয়ে গেল সেই ব্যবধান। ইন্দু পরে বললেন, “ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না এই অনুভূতির কথা।”
ঘটনার প্রেক্ষাপট জানতে পিছিয়ে যেতে হবে ৪২ বছর। অসমের তেজপুর। ১৩ বছরের নন্দিনী (নাম পরিবর্তিত) প্রেমে পড়েছিল। তার শরীরে তখন নতুন প্রাণের সঞ্চার। সমাজের রক্তচক্ষুকে আড়াল করে চার হাত এক করতে চেষ্টার কসুর করেনি নন্দিনীর পরিবার। কিন্তু তাঁদের অকূল পাথারে ভাসিয়ে এক দিন উধাও হয়ে যায় সেই প্রেমিক। আজ অবধি তার আর খোঁজ মেলেনি। ভূমিষ্ঠ কন্যাসন্তানের ঠাঁই হয় তেজপুরের হোমে। সেখান থেকে কলকাতায় মাদার টেরিজ়ার মিশনারিজ় অব চ্যারিটিতে।
সেটা ১৯৮০ সাল। সাত হাজার কিলোমিটার দূরে অস্ট্রিয়ার এক শহর থেকে নিউবর দম্পতি শহরে এসে সেই মেয়েকে দত্তক নিয়ে চলে যান। তবে ঠিক হয়, নন্দিনীর দেওয়া ইন্দু নামটা থেকে যাবে। অস্ট্রিয়ার পাসপোর্টে তাই এখনও জ্বলজ্বল করে, ইন্দু নিউবর। বেশ চলছিল জীবন। নার্সের কাজ। দত্তক বাবা-মা, স্বামী-কন্যা নিয়ে সংসার। কিন্তু বহু চন্দ্রভুক অমাবস্যা শেষে এক শীতের সকালে আচমকাই হু হু করে ওঠে মন। “কেমন ছিল আমার মা, জানতে বড় সাধ জেগেছিল,” ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ইন্দুর গলা।
এ দেশের এমন সব পরিত্যক্ত পুত্রকন্যারা অনেকেই এখন বিদেশি দত্তক পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায়। তাঁদের অনেকেই ইন্দুর মতো একবার ফিরে আসতে চান জন্মদাত্রীর কাছে। যে অসহায় অবস্থায় নন্দিনীরা নিজেদের সন্তানদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন, তা বিদেশের মাটিতে বসে এক সময় অনুধাবন করতে পারেন ওঁরা। নাড়ির টানে একবার অন্তত দাঁড়াতে চান মায়ের সামনে। আর এই কাজে তাঁদের সাহায্য করেন পুণের অঞ্জলি পওয়ার আর অরুণ ডোল।
অরুণও এমনই এক দত্তক সন্তান। দীর্ঘদিন জার্মানিতে থাকার পরে এখন ভারতে এসে বাস করছেন। এক দিন তিনিও এমন করেই খুঁজে বার করেছিলেন তাঁর জন্মদাত্রীকে। অঞ্জলি বলেন, “সকলের কপাল অবশ্য অরুণ বা ইন্দুর মতো ভাল নয়। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে সুইৎজ়ারল্যান্ডের সোনা মুথুলিঙ্গমের মা-কে অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি।’’ অনেকেই আসলে যে বিপর্যয়ের মধ্যে সন্তানকে হোমে দিতে বাধ্য হন, সেই কাহিনি সারা জীবনই রেখে দিতে চান লোকচক্ষুর আড়ালে। জনসমক্ষে আসতে চান না আর।
কিন্তু ইন্দুর মা নন্দিনীর গল্পটা ভিন্ন। কৈশোরের প্রেমকে ভুলতে পারেননি আজও। তাই সংসার করা আর হয়নি। তেজপুরে এক টিনের ঘরে দিদির সংসারে এক কোণে পড়ে থাকেন। অঞ্জলি বলেন, “নন্দিনীকে খুঁজে বার করতে আমাকে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি। হোমে থাকা পুরনো ঠিকানা ধরে বার তিনেক তেজপুর যাতায়াত করে তাঁকে পাই। ইন্দুর কথা শোনামাত্র হাপুস নয়নে কেঁদে ফেলেছিলেন।”
নিয়ম মেনে সুদূর আমেরিকায় ডিএনএ ম্যাচিং হল দু’জনের। মিলে যেতেই ১৯ বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের বিমান ধরলেন ইন্দু। বৃহস্পতিবার দেখা হল দু’জনের। নন্দিনী আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। থাকতে চেয়েছেন আড়ালেই। ইন্দুর কাছে ভারত এত দিনে পূর্ণ রূপে মাতৃভূমি হল।