বলিরেখা ভরা মুখ, বয়সের ভারে কোমরের সমস্যা থাকায় বাঁ হাতটা কোমরে রেখেই হাঁটেন। খুব জোরে হাঁটাচলা করতে পারেন না। বয়স হার মেনেছে শুধু একটা জায়গাতেই। নিশানা আর লক্ষ্যভেদ।
দৃঢ় দৃষ্টি আর নির্ভুল নিশানায় আজও তিনি যে কোনও লক্ষ্যকে ভেদ করতে পারেন। এই বয়সেও তাঁর বন্দুকবাজিতে মেতে সারা গ্রাম। তিনি ‘রিভলভার দাদি’। প্রকৃত নাম চন্দ্র তোমর। বিশ্বের প্রবীণতম শুটার।
যে বয়সে কাজ থেকে অবসর নিয়ে নেন সবাই, সেই বয়স থেকেই এক নতুন জার্নি শুরু করেছিলেন চন্দ্র। ৬৫ বছর বয়সে তিনি প্রথম তাঁর অসামান্য এবং নির্ভুল শুটিংয়ে তাক লাগিয়ে দেন বিশ্বকে। এখন তিনি ৮৭ বছরের। বয়সের ছাপ যদিও বন্দুকবাজিতে বিন্দুমাত্র পড়েনি।
উত্তরপ্রদেশের বাগপত জেলার জহরি গ্রামের বাসিন্দা তিনি। প্রত্যন্ত এই গ্রামে মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরনো ছিল একপ্রকার ‘নিষিদ্ধ’। বাড়ির মহিলারা বাইরে গিয়ে কাজ করবেন! ছি ছি পড়ে যেত গ্রামে। এমন একটা গ্রামে থেকে ৬৫ বছর বয়সে বাড়ির বাইরে পা দেওয়াটা ভীষণ কঠিন ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু নিশানা যদি সঠিক হয়, লক্ষ্যভেদ যে হবেই।
রিভলভার দাদির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। ছোট থেকেই শুটিংয়ে খুব আগ্রহ ছিল তাঁর। কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারে কোনও দিন মুখ ফুটে নিজের ইচ্ছা জাহির করার অবকাশ ছিল না। সংসার, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি এই নিয়েই জীবনের ৬৫টা বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ৮ সন্তান, ১৫ নাতি-নাতনি।
নাতনি শেফালির বন্দুকবাজিতে আগ্রহ দেখে একদিন তাঁকে সঙ্গে করে জহরির রাইফেল ক্লাবে ভর্তি করাতে যান চন্দ্র। সেখানে গিয়ে নিজে হাতে বন্দুক তুলে শুট করেন। প্রথম শুটিংয়েই টার্গেটের ঠিক মাঝখানে লাগিয়ে দেন তিনি। তাঁর বন্দুকবাজি দেখে রাইফেল ক্লাবের প্রত্যেকে অবাক হয়ে যান।
নাতনির সঙ্গে তাঁকেও প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগেন কোচ। দাদিও তাতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিতে গেলে যে সময় তাঁকে দিতে হবে, তার উপায় ছিল না। এর তীব্র বিরোধী ছিল তাঁর রক্ষণশীল পরিবারও। প্রথম প্রথম স্বামীর সমর্থনও পাননি তিনি। গ্রামবাসীরাও তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করতে শুরু করেন।
সব বাধা উপেক্ষা করে ৬৫ বছর বয়সে নতুন পথে চলা শুরু তাঁর। পরিবারের কেউ যাতে তাঁর দিকে আঙুল তুলতে না পারেন, সে জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ করতেন। রান্না করা, গরুর দেখভাল করা— এ সব শেষ করে তারপর যেতেন প্রশিক্ষণ নিতে।
আর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাড়িতেই প্রাকটিস করতেন তিনি। ভারী বন্দুক ধরে নিশানা করার সময় হাত যাতে কেঁপে না যায়, তাই একটা বড় জগে জল ভর্তি করে দীর্ঘক্ষণ বন্দুকের মতো ধরে থাকতেন। ফের সকাল হলেই সংসারের কাজে লেগে পড়তেন।
এ ভাবেই লক্ষ্যভেদ করে ১০০টারও বেশি পদক জিতে নিয়েছেন তিনি। তারমধ্যে ৩০টা জাতীয় স্তরের পুরস্কার রয়েছে। তিনি বিশ্বের প্রবীণতম শুটার। এতদিন যাঁরা তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন, তাঁরাই এখন সমীহ করে চলেন। পরিবারও তাঁকে পূর্ণ সমর্থন দেয়।
চন্দ্র তোমর বর্তমানে গ্রামের অনু্প্রেরণা। জোহরি থেকে বহু মানুষ শুটিং প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছেন তাঁর কাছে। গ্রামের মেয়েরাও শুটিংয়ের প্রশিক্ষণ নেন।
শোনা যায়, গ্রামে কোনও মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে পণ চাইলে তাঁরা নাকি দাদি আম্মার কথা বলা হয়। দাদি আম্মার নাম শুনে কেউ আর পণ নেন না।
সম্প্রতি তাঁর জীবনী ক্যামেরাবন্দি করেছেন পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ। চলতি বছরই চন্দ্রার বায়োপিক ‘সান্ড কি আঁখ’ মুক্তি পাবে। তাতে তাপসী পান্নু এবং ভূমি পেডনেকরকে দেখা যাবে।
জহরি গ্রামে আরও এক দাদি আম্মা রয়েছেন। তাঁরও রিভলভারের নিশানা তাক লাগানো। তিনি প্রকাশি তোমর। তিনি সম্পর্কে চন্দ্র তোমরের জা। ২০০০ সালে প্রকাশি তোমর শিরোনামে আসেন। তাঁর বয়সও ৬০ বছর পেরিয়েছে। বড় জা চন্দ্র তোমরই তাঁর অনুপ্রেরণা, জানিয়েছেন তিনি।
তাঁরও কাহিনি অনেকটা চন্দ্রর মতোই। চন্দ্র তোমরের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মেয়ে সীমা তোমরকে তিনি রাইফেল ক্লাবে ভর্তি করাতে গিয়েছিলেন। কারণ মেয়ে সীমাও একা যেতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন।
কী ভাবে রাইফেল ধরে নিশানা লাগাতে হয়, তা সীমাকে হাতে ধরে বোঝাচ্ছিলেন নিজেই। তাঁর নিশানা দেখে অভিভূত হয়ে যান কোচ। তাঁকে প্রশিক্ষণ নিতে বলেন তিনি। ‘সান্ড কি আঁখ’ ছবিতে তাঁর উল্লেখও রয়েছে।