আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই তাঁর জীবন চলছিল। কেরলের কালিকটের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম মুক্কাম। সেই গ্রামেই তাঁর বেড়ে ওঠা।
মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তাঁর জীবন পুরোপুরি বদলে যায়। সে দিন সবেমাত্র স্কুল থেকে ফিরেছিল সে। স্কুলের পোশাক খোলার আগেই মা এগিয়ে এসে তাঁর হাতে চায়ের কাপ ভর্তি ট্রে ধরিয়ে দিলেন।
বাড়িতে তখন ভর্তি লোকজন। তাঁদের চা পরিবেশন করে, তাঁদের কথার সমস্ত উত্তর দেন। তারপর অতিথিরা চলে যাওয়ার পর বাড়ির লোকজনের কথাবার্তায় বুঝলেন, এঁরা তাঁকেই দেখতে এসেছিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন জ্যাসমিন এম মুসা। তিনি যে বিয়ের জন্য একেবারেই প্রস্তুত নন, তা বারবার বাড়ির লোককে জানিয়েও কোনও ফল মেলেনি।
বাড়ির লোকও কোনওরকম খোঁজখবর না নিয়েই এর এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর এনগেজমেন্ট করিয়ে দেন। আর তার তিনদিন পর জ্যাসমিন ১৮ বছর বয়সে পা দিলেই বাড়ির লোক তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন।
কার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হতে চলেছে, সেটাও জানতেন না তিনি। বিয়ের দিনই প্রথম স্বামীর মুখ দেখেন। বিয়ের রাতে যখন তাঁর ঘরে প্রবেশ করেছিলেন স্বামী, তখনই স্বামীর আচার-ব্যবহারে কিছু অস্বাভাবিকত্ব দেখেছিলেন।
তাঁকে ধর্ষণ করতে শুরু করেন স্বামী। আর সারারাত চিত্কার করতে থাকেন জ্যাসমিন। কিন্তু জ্যাসমিনের দুর্ভাগ্য, চিত্কার শুনেও কেউ একবারও তাঁর খোঁজ নিতে আসেননি। বরং এটাই খুব স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হত তাঁদের এলাকায়। কারণ বেশির ভাগ মেয়েরই খুব কম বয়সে বিয়ে হত। আর তাই বিয়ের প্রথম রাতে এমন আর্তনাদ যেন সকলের কাছেই গা সওয়া ছিল।
জ্যাসমিনের জীবনে বিয়েটা একটা অভিশাপের মতো ছিল। রোজই তাঁকে ধর্ষণ করতেন স্বামী। বিয়ের মাস খানেক পর তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর স্বামী আসলে মানসিক ভাবে অসুস্থ। বিয়ের এক বছর পর বিবাহবিচ্ছেদ, বাপের বাড়ি চলে যান জ্যাসমিন।
কিন্তু তখনই জ্যাসমিনের সমস্যা দূর হওয়ার ছিল না। সমাজ নানা ভাবে তাঁকে অপ্রস্তুত করে তুলতে শুরু করে। পরিবারের কাছেও ক্রমে একটা বোঝায় পরিণত হয়েছিলেন জ্যাসমিন। তাঁকে দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে পরিবার।
কিন্তু এ বারে বিয়ের আগে স্বামীর সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলার জেদ ধরে বসেন জ্যাসমিন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লেগে গিয়েছিল জ্যাসমিনের। ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন, তেমনটাই স্বামী পেতে চলেছেন তিনি, এমনই মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু অবাক হওয়ার অনেক বাকি ছিল।
বিয়ের প্রথম রাতে কোনও কারণ ছাড়াই স্বামী তাঁকে মারধর শুরু করেন এবং হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ করেন। তারপর থেকে প্রতিটা রাতই জ্যাসমিনের কাছে বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন মাদকাসক্ত। ড্রাগের নেশায় প্রতিরাতে এ ভাবেই তাঁর উপর নির্যাতন চালাতেন। কাউকে না জানানোর হুমকিও দিয়ে রেখেছিলেন জ্যাসমিনকে।
জ্যাসমিনও ভয়ে গুটিযে থাকতেন। বাঁচার ইচ্ছাই চলে গিয়েছিল তাঁর। এর মধ্যেই তাঁর জীবনে বাঁচার প্রেরণা এসে হাজির হয়। জ্যাসমিন অন্তঃসত্ত্বা হন। কিন্তু স্বামী সেটা জানতে পারার পরই রেগে গিয়ে তাঁর পেটে লাথি মারেন।
রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। জ্যাসমিন তখন পাঁচ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তাঁর ইউটেরাস এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, তাঁর বাচ্চাকে বাঁচানো যায়নি। পুরো বিষয় জ্যাসমিন বাড়ির লোককে জানান। ইতিমধ্যে স্বামী তাঁকে ডিভোর্স দিতে চেয়ে কোর্টে আবেদন জানান।
কিন্তু জ্যাসমিন স্বামীর বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার মামলা করেন। পুলিশ তাঁর স্বামীকে গ্রেফতারও করে। প্রচণ্ড ট্রমায় ছিলেন জ্যাসমিন। বিদেশে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের লোকজন তাঁকে সেটা করতে দেননি। পাসপোর্ট পুড়িয়ে দেন।
কোচিতে পালিয়ে যান তিনি। সেখানে প্রথমে একটা ফিটনেস সেন্টারের রিসেপশনিস্ট-এর কাজে যোগ দেন। ফিটনেসের উপরে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন বেঙ্গালুরু থেকে। এই মুহূর্তে বেঙ্গালুরুরই একটি ফিটনেস সেন্টারের ট্রেনার তিনি। শারীরিক এবং মানসিক দু’ভাবেই নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছেন। এখন তাঁর মতো হিংসার শিকার অন্য মহিলাদের বদলাচ্ছেন জ্যাসমিন।