মানাল ইউনুস।
‘... অন ইওর হোয়াইট ক্যানভাস... কালার মি ওয়াইস... কালার মি স্ট্রং’। তোমাদের সাদা ক্যানভাসে... বিবেচনার রং দাও... শক্তির রং দাও।
সে দিনের জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভাল তত ক্ষণে জমে উঠেছে। কোন লেখক কত প্রতিবাদী, কে কত এগিয়ে আছেন, এমন কত ধরনের কথা চারপাশে। সে সবের মাঝে রোদ ঝলমল দুপুরে খাবারের প্লেট হাতে ছিপছিপে চেহারার মেয়েটি এগিয়ে এলেন এক সঙ্গীনীর সঙ্গে। ‘‘একটু রাখব থালাটা?’’প্রশ্ন তাঁর।
ছোট্ট টেবিলে আরও দু’টি খাবারের প্লেট রাখার জায়গা হল। পাশের অস্ট্রেলীয় ভ্রমণ লেখকের সঙ্গে তখন গল্প জমেছে ভারতীয় সাংবাদিকের। হঠাৎ কানে ভেসে এল নবাগতাদের কথোপকথন। ‘‘কাগজের কাপে ওটা কী গো? আমাদের দিল না তো?’ সঙ্গী বলল, ‘‘আরে ওটা ওয়াইন। তুমি খাও না তো!’’
আরও পড়ুন: বয়কট করল উড়ান সংস্থা, কুণালের প্রশ্ন, ‘আমি কি হাঁটতে পারি মোদীজি’
গল্প থেমে গেল।
ঘুরে তাকাল গোটা টেবিল। শীর্ণকায়, মাথায় রঙিন ওড়না বাঁধা মেয়েটি অপ্রস্তুত। ভারতীয় সঙ্গী আলাপ করিয়ে দিলেন,‘‘ও মানাল। মানাল ইউনুস। কবিতা লেখে।’’ সপ্তাহব্যাপী সাহিত্য উৎসবে দেশ-বিদেশ থেকে যোগ দিতে আসা সাড়ে তিনশো বক্তার মধ্যে তিনিও এক জন। আশপাশের চাউনিতে বাড়তি সম্মান এল।
বছর কুড়ির মানালের ব্যবহার বলছে, তখনও অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তাঁর মন।
কী নিয়ে লেখেন মানাল?
‘‘ইসলাম!’’ ঝট করে উড়ে এল উত্তর।
ওয়াইনের আলোচনা ঘুরে গেল ধর্মে। গল্প গড়াল খাওয়ার জায়গার বাইরে।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডের বাসিন্দা মানাল আদতে এরেট্রিয়ার মানুষ। স্বৈরাচারী সরকারের ভয়ে সে দেশের অনেকেই ঘর ছেড়েছেন। তাঁদের মধ্যেই পড়ে তাঁর পরিবারও। মানালের বয়স তখন মাত্র চার বছর। সে সময়ের কথা তেমন কিছুই মনে নেই তাঁর। তবু সেই দেশ ছাড়ার ঘটনাই বারবার তাঁকে লিখতে শিখিয়েছে। বলতে শিখিয়েছে। অন্যের সামনে দাঁড়ানোর যে জোরের প্রয়োজন রয়েছে, তা বুঝতে শিখিয়েছে।
কী ভাবে?
মানালেরও এ সব কথা ভাবতে অবাক লাগে। কিন্তু যবে থেকে বোধ হয়েছে, তবে থেকেই তিনি জানেন যে, সাদা চামড়ার চারপাশটার থেকে তাঁরা আলাদা। সেই আলাদা হওয়ার কারণ কী? সেই যে তাঁরা দেশছাড়া। তাঁরা অন্য রং। অন্য ধর্ম, অন্য ভাষা। তারই মধ্যে কখন যেন শিখে গিয়েছিলেন, ইসলামকে জাপটে ধরেই এ ভিন্নতার মধ্যে বাঁচতে হবে। সেটিই তাঁর পরিচয়। তা নিয়ে গর্বিত থাকতে হবেই।
আরও পড়ুন: দেশবিরোধী কার্যকলাপ নয়, আইআইটি বম্বের নির্দেশিকা ঘিরে বিতর্ক
কিন্তু গর্বের কারণ যেমন থাকে, তেমন তো ততটা গর্বিত না হওয়ার মতো কারণও থাকে। তার কী হবে? সে সব প্রশ্নের সঙ্গে বোঝাপড়া করিয়ে দেয় তাঁকে তাঁর নিজের কবিতা।
ছাপেন না সে সব আগেই। সোজা সমাজের নানা কোণে গিয়ে শোনান নিজের কণ্ঠে। মানাল কবিতা পারফর্ম করেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই উপস্থাপনার মাধ্যমেই অনুভূতির বিনিময় ঘটবে। একটু একটু করে খুঁজে নেওয়া হবে ইসলামের মানে। নিজের পরিচয়ের মানে। তাঁর ভরসার মানে।
যেমন তিনি গায়ের রং নিয়ে সমস্যার কথা বলেন, ঠিক সে ভাবেই ধর্মের ভিত্তিকে সীমান্তকরণের কথা বলেন। সে সব কথা বলার জন্য নিজের ধর্মের পরিচয়টাও মাঝেমাঝে গুলিয়ে যায় কি? মানাল বলেন, ‘‘গুলিয়ে যে একেবারে যায় না, তা নয়। কিন্তু দুনিয়ায় সবই এক এক সময়ে গোল গোল লাগে। তখন আবার নিজের বিশ্বাসকে ভরসা করেই এগিয়ে চলি।’’ ইসলাম ঘিরে অনেক ‘ভুল’ ধারণা রয়েছে বিশ্বাসীদের মধ্যে। সেগুলো শুধরে দিতে চান মানাল। রোজ নতুন করে নিজের পরিচয় আর ইসলামের পরিচয়টা একটু একটু করে, প্রয়োজন মতো, বদলে ফেলতে চান। সে কারণেই হিজাবে মুখ না ঢাকলেও, মাথা ঢাকেন স্কার্ফ দিয়ে। নিজের বিশ্বাস, নিজের পরিচয়বোধ, নিজের ভালবাসা ছাড়তে চান না। তবে তাঁর বিশ্বাস যাতে অন্যের ভয়ের কারণ না হয়, তাই যোগাযোগ স্থাপন করতে চান।
ইসলামে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের ইসলাম-বোধে বিবেচনাশক্তির ব্যবহার বাড়াতে চান তিনি। কারণ, না হলে অ্যাডিলেডে নিজের ঘরে বসেও চার দেওয়ালের থেকে বড় আলাদা লাগে নিজেকে। এই অপর হয়ে থাকায় আর বিশ্বাস রাখতে পারেন না যে এই কন্যা! তাই বেরিয়ে পড়েন মাঝে মাঝেই। এ দেশ-সে দেশে নিজের কবিতা শোনান। বলেন ভালবাসার কথা।