আর্জি নিয়ে এর আগে নরেন্দ্র মোদীর কাছে মমতা। — ফাইল চিত্র
আসন্ন দিল্লি সফরে সামাজিক প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছাঁটাই নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিযোগ জানাবেন মুখ্যমন্ত্রী।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে সোমবার দিল্লি আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সুযোগে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, কেন্দ্র বরাদ্দ ছাঁটাই করায় রাজ্যের গরিব মানুষ এবং অনগ্রসর এলাকার উন্নয়নের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সেই প্রসঙ্গই তুলে ধরবেন তিনি।
সিপিএম-কংগ্রেসের মতো বিরোধীরা অবশ্য সারদা-তদন্তের আলোয় মমতার দিল্লি সফরকে কটাক্ষ করছে। তাদের দাবি, সিবিআইয়ের তৎপরতা নতুন করে সামনে আসার পরে মোদীর সঙ্গে দেখা করে একটা বোঝাপড়ায় আসতে চান মমতা। সিপিএম নেতৃত্ব দিন কয়েক আগেই অভিযোগ করেছেন, এর আগে মমতা-মোদী বৈঠকের পরে সারদা-তদন্তে তৃণমূল নেতাদের তলব করা বন্ধ করে দিয়েছিল সিবিআই। তারা ফের নড়েচড়ে বসতেই মমতা দিল্লি যাচ্ছেন আরও এক বার মোদীর দ্বারস্থ হতে। তা ছাড়া, পাকিস্তানি চরচক্রেও রাজ্যের শাসক দলের নাম জড়িয়েছে। দেশদ্রোহের অভিযোগ ছাড়া ইউএপিএ-তেও মামলা হয়েছে কয়েক জন তৃণমূল কর্মীর বিরুদ্ধে। তা নিয়েও মমতা চাপে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের বিজেপি বিরোধিতা চোখে পড়ার মতো কমে এসেছে বলেই দাবি বিরোধীদের। উদাহরণ হিসেবে সংসদে গোলমাল না-করা এবং জিএসটি বিলকে সমর্থন করার যে ঘোষণা রাজ্যের শাসক দল করেছে, তা-ই তুলে ধরছেন তাঁরা।
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূল শিবিরের বক্তব্য, এটা ঠিকই যে মমতা এখন কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে যেতে রাজি নন। তবে বিজেপির সঙ্গে গোপন বোঝাপড়ার অভিযোগ ঠিক নয়। জিএসটি প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতারা বলছেন, এই করকাঠামোকে সমর্থন করার বিষয়টি তো দলের ঘোষিত অবস্থান। আর সংসদ অচল করে রাখলে জনমানসে ভাবমূর্তি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কংগ্রেসও সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তবে একই সঙ্গে তৃণমূল নেতারা এ-ও জানাচ্ছেন যে, অসহিষ্ণুতা নিয়ে মোদী সরকারকে আক্রমণ মমতা এমন তিক্ততায় নিয়ে যেতে চান না, যাতে রাজ্যের দাবিপূরণে বাধা আসে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের স্বার্থই তাঁর অগ্রাধিকার।
মোদীর কাছে কী কী অভিযোগ জানাবেন মমতা?
নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে— সর্বশিক্ষা অভিযান, আইসিডিএস, মিড-ডে মিল, খাদ্য সুরক্ষা, মাওবাদী অধ্যুষিত জেলাগুলির উন্নয়ন থেকে অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন তহবিলের মতো বিভিন্ন খাতে মোদী সরকার অর্থ বরাদ্দ কমিয়েছে। এই সব প্রকল্পে কেন্দ্র আগে যে অনুপাতে টাকা দিত, এখন তার থেকে অনেক কম দিচ্ছে। ফলে যে ফাঁক তৈরি হচ্ছে, ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চলা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। সে কারণে টান পড়ছে সামাজিক প্রকল্পে। মমতা মোদীকে জানাবেন, কেন্দ্রের এই একতরফা সিদ্ধান্তে সমাজের নিচুতলার, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষই বিপদে পড়ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অবশ্য বক্তব্য, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে এখন অনেক বেশি অর্থ রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সেই বাড়তি অর্থ যেখানে ইচ্ছে খরচ করতে পারে রাজ্য সরকার। কোনও বিধিনিষেধ নেই। সেই কারণেই ওই প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের দাবি খতিয়ে দেখতে রাজি কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রে বলা হচ্ছে, মোদী খোলা মনেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ জানালে তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। উন্নয়নের প্রশ্নে রাজনীতি না-করে, রাজ্যকে সাহায্য করার নীতি নিয়েই চলতে চান নরেন্দ্র মোদী।
নবান্ন সূত্রের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মূলত প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামের পরিকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতেই জোর দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। যেমন সর্বশিক্ষা অভিযান। এই প্রকল্পে বরাদ্দ গত অর্থবছরে ছিল ৮৮৯৪ কোটি টাকা। এ বছর এক ধাক্কায় তা কমে এসেছে ২০০০ কোটি টাকায়! মিড-ডে মিলে বরাদ্দ কমেছে ৬৭ শতাংশ! আইসিডিএস-এ-ও বরাদ্দ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে! রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা, পূর্ব ভারতে সবুজ বিপ্লব, খাদ্য সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমায় শুধু পশ্চিমবঙ্গেই এই তিনটি প্রকল্পে ৩৩৪ কোটি টাকার ঘাটতি হবে বলে নবান্নের দাবি।
বিধানসভা ভোটের আগে আরএকটি বিষয়ও চিন্তায় ফেলছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। মাওবাদী এলাকার উন্নয়নের জন্য এত দিন কেন্দ্রীয় সরকার ৩৫টি জেলাকে ৩০ কোটি টাকা করে দিত। জঙ্গলমহল সংলগ্ন তিনটি জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়াও এই সুবিধা পেয়েছে। এ বার
কেন্দ্র আর সেই টাকা দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এই সব জেলায় গত বছর এমন অনেক কাজ শুরু হয়েছে, যেগুলির কাজ এ বছরের টাকা পেলে শেষ হওয়ার কথা। একই ভাবে অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন তহবিলের আওতায় রাজ্যের ২১টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলায় গ্রামের পরিকাঠামো
তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। কোথাও সড়ক-সেতু, কোথাও পঞ্চায়েত হাট বা আইসিডিএস-কেন্দ্র। এই খাতেও কেন্দ্র অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করছে। বিপুল ঋণের বোঝা সামলে এই প্রকল্পগুলির কাজ শেষ করার অর্থ যে রাজ্যের কোষাগারে নেই, তা বলাই বাহুল্য। এ বিষয়েও মোদীকে জানাবেন মমতা।
মমতার সরকারের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা কমাতে কেন্দ্র কোনও সাহায্য করেনি। ঋণের বোঝা বাড়তে বাড়তে পৌনে তিন লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে গিয়েছে। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর হিসেব অনুযায়ী, তাঁর সরকারের আমলে যে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা নতুন ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার প্রায় ৭৬ হাজার কোটিই ব্যয় হয়েছে পুরনো ঋণ মেটাতে। বার বার দাবির পর প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন কেন্দ্র অনগ্রসর এলাকা উন্নয়নের বিশেষ তহবিল থেকে ৮৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে। তার মধ্যে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৫৫৮২ কোটি টাকা মঞ্জুর হয়েছে। রাজ্য তার থেকেও প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বেশি খরচ করে ফেলেছে। অথচ কেন্দ্র তা মঞ্জুর করেনি।
কী বলছে নরেন্দ্র মোদী সরকার?
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, যে হেতু সার্বিক ভাবে অনেক বেশি অর্থ রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, সেই কারণেই প্রকল্প ভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ কমানো হয়েছে। রাজ্যের পাল্টা যুক্তি, কেন্দ্র এক হাতে যা দিচ্ছে, অন্য হাতে তার থেকে অনেক বেশি কাটছাঁট করছে। কেন্দ্রের আবার যুক্তি, নতুন ব্যবস্থায় রাজ্য যে প্রকল্পে বেশি গুরুত্ব দেবে, শুধু সেখানেই খরচ করবে। আগের ব্যবস্থায় রাজ্যে কোনও প্রকল্পের প্রয়োজন না-থাকলেও কেন্দ্র অর্ধেক খরচ দিলে রাজ্যকে বাকি অর্ধেক দিয়ে তা চালাতে হতো। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাই এত দিন বলছিলেন, কেন্দ্র টাকা দিয়ে দিক। রাজ্য যেখানে প্রয়োজন মনে করবে, সেখানে ব্যয় করবে। সেই নীতিই নেওয়া হয়েছে। মমতাকেও এটাই বুঝিয়ে বলবেন মোদী।