ব্রিটিশ ভারতের দেশীয় রাজপরিবারের মধ্যে অন্যতম ছিল গায়কোয়াড় বংশ। প্রাচীন মরাঠা সাম্রাজ্যের মূল শহর বডোদরা ছিল তাদের শাসনের কেন্দ্র। এখন গুজরাতের অন্তর্গত গুরুত্বপূর্ণ এই শহর। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে গায়কোয়াড়দের প্রতিপত্তির প্রতীক লক্ষ্মীবিলাস প্যালেস।
মহারাজা তৃতীয় সয়াজি গায়কোয়াড় ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে এই প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন। প্রায় ১৩০ বছর আগে সে সময় খরচ পড়েছিল ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাতাশ লক্ষ টাকা।
ইন্দো গথিক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই প্রাসাদকে বলা হয় বিশ্বের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সবথেকে বড় বাসভবন।
প্রাসাদ নির্মাণের সূত্রপাতেই জড়িয়ে আছে শোকপর্ব। বডোদরার রাজপরিবারের তরফে প্রাসাদের নকশা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিখ্যাত স্থপতি মেজর চার্লস মান্ট-কে।
কিন্তু নকশা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে মান্টকে এক অদ্ভুত ভয় ঘিরে ধরে। তাঁর কেবলই মনে হতে থাকে, যদি তাঁর হিসেবে কিছু ভুল হয়ে থাকে! যদি প্রাসাদ ভেঙে পড়ে! শোনা যায়, এই আতঙ্কে শেষ অবধি তিনি আত্মঘাতী হন। অথচ এর আগে ব্রিটিশ ভারতে একাধিক প্রাসাদ ও স্থাপত্য নির্মাণের মূল স্থপতি ছিলেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত প্রাসাদ তৈরির কাজ ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে শেষ করেন আর এক স্থপতি রবার্চ ফেলোজ চিশোলাম। প্রায় ১২ বছর ধরে তৈরি হয়েছিল এই প্রাসাদ।
আয়তনে বাকিংহাম প্যালেসের চার গুণ বড় এই প্রাসাদ। প্রাসাদের অন্দরসজ্জা অনুসরণ করেছে ব্রিটিশ ঘরানাকে।
৫০০ একরের বেশি জমি জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাসাদে প্রথম দিন থেকেই সবরকম আধুনিক সুবিধের দিকে নজর রাখা হয়েছে।
ইউরোপীয় অতিথিদের জন্য মহারাজা প্রতাপ সিংহের নির্দেশে তিরিশের দশকে এই প্রাসাদে তৈরি হয়েছিল গল্ফ কোর্স।
তিন দশক পরে প্রতাপসিংহের নাতি সমরজিৎ সিংহের আমলে সেই গল্ফ কোর্স সংস্কারের পরে খুলে দেওয়া হয় জনসাধারণের দ্রষ্টব্য হিসেবে।
প্রায় ১৭০টি ঘর বিশিষ্ট এই প্রাসাদের চত্বরে রয়েছে একাধিক সুরম্য মহল। তার মধ্যে অন্যতম মোতিবাগ প্যালেস এবং মহারাজা ফতেহ সিংহ মিউজিয়াম।
তবে এই সংগ্রহশালার ভবন নির্মিত হয়েছিল রাজপরিবারের শিশুদের স্কুলের জন্য। কিন্তু পরে তা রূপান্তরিত হয় সংগ্রহশালায়। প্রাসাদের আমবাগানের মধ্যে দিয়ে পাতা হয়েছিল ছোট্ট রেললাইন। বিশেষ রেলগাড়িতে রাজপরিবারের সন্তানরা স্কুলে যেত এবং আবার ফিরত প্রাসাদে।
প্রাসাদের ভিতরেই আছে প্রাচীন ধাপকুয়ো বা স্টেপ ওয়েল। তার নাম ‘নবলাখি বাওলি’। শোনা যায়, এটা প্রাসাদ তৈরির কয়েকশো বছর আগে থেকেই সেখানে ছিল।
প্রাসাদের দর্শনীয় অংশগুলির অন্যতম গাড্ডি হল, দরবার হল এবং রাজ অস্ত্রশালা। অস্ত্রশালায় অন্যান্য অস্ত্রের সঙ্গে সযত্নে রাখা আছে বাঘনখও। গোপনে প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে বাঘনখ ছিল যে কোনও শাসকের অন্যতম ভরসা।
‘গাড্ডি হল’ সেই কক্ষ, যেখানে অভিষিক্ত হয়ে সিংহাসন গ্রহণ করতেন এই বংশের রাজারা।
দরবার হলে বসত নানারকম অনুষ্ঠানের আসর। ঝাড়বাতি, বেলজিয়াম আয়নায় সুসজ্জিত এই কক্ষ দুর্মূল্য শিল্পকলার আকর।
স্থপতি চার্লস মান্টের আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। মূলত তাঁর নকশাতেই নির্মিত এই প্রাসাদ ভেঙে পড়েনি। ১৩০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাজগৌরবের প্রতীক হয়ে। রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হলেও গায়কোয়াড় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা এখনও থাকেন এই ভবনেই। প্রাসাদের নির্দিষ্ট অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে দর্শকদের জন্য। দর্শকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে সুরম্য ভবন। (ছবি: শাটারস্টক ও ফেসবুক)