বাল্মীকিকে নিয়ে ত্রিমুখী টানাটানি

বাল্মীকি, অর্থাৎ উত্তর ভারতের দলিত সমাজের একেবারে নিচু তলায় পড়ে থাকা শ্রেণি। একই সঙ্গে ব্রাহ্মণ-সহ উচ্চবর্ণ এবং সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়া অগ্রসর দলিত (জাঠভ) সম্প্রদায় তাঁদের ‘শোষণ’ করে বলে বাল্মীকিদের অভিযোগ।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০২:১৯
Share:

বাল্মীকি, তুমি কার?

Advertisement

চলতি লোকসভা ভোটের মরসুমে এই প্রশ্নটি উত্তরপ্রদেশের যুযুধান দলগুলির কাছে ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে চলছে ‘বাল্মীকি’-কে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টাও।

বাল্মীকি, অর্থাৎ উত্তর ভারতের দলিত সমাজের একেবারে নিচু তলায় পড়ে থাকা শ্রেণি। একই সঙ্গে ব্রাহ্মণ-সহ উচ্চবর্ণ এবং সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়া অগ্রসর দলিত (জাঠভ) সম্প্রদায় তাঁদের ‘শোষণ’ করে বলে বাল্মীকিদের অভিযোগ। এ বার তাঁদের ভোট টানতে ঝাঁপিয়েছে সব দলই। সব চেয়ে বেশি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর। উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, অভিমান এবং ক্ষোভ নিয়ে নব্বইয়ের দশকে কংগ্রেস এবং পরে মায়াবতীর পাশ থেকেও সরে গিয়েছে এই বাল্মীকি সম্প্রদায়। সেই হারিয়ে যাওয়া ভোটব্যাঙ্ক এ বারের তুল্যমূল্য লড়াইয়ে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, এটা জানেন মায়াবতী। তিনি চাইছেন অখণ্ড দলিত মননের সমর্থন। ২০১৪ সালে বাল্মীকিদের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে শুরু করেছিল বিজেপি। ২০১৭ সালে তাদের ভোটব্যাঙ্কের অনেকটাই দখল করেছিল তারা। উত্তরপ্রদেশের ৪০০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৩২৫টিই যোগী আদিত্যনাথের হাসিল করার পিছনে নিম্নবর্গীয় এই সম্প্রদায়ের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

Advertisement

উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক শিবির জানাচ্ছে, সে রাজ্যের দলিত সম্প্রদায় মোট ৬৫টি জনজাতিতে বিভক্ত। সেই জনজাতিদের ৫০ শতাংশ জাঠভ (মায়াবতী নিজেও), ১৫ শতাংশ পাসি এবং বাকি অংশে বাল্মীকিরা রয়েছেন। বিএসপি-র প্রতিষ্ঠাতা কাঁসিরামের জীবনীকার বদ্রি নারায়ণের মতে, ‘‘জাঠভ এবং বাল্মীকি— দু’টিই শহরভিত্তিক সম্প্রদায়। কিন্তু এঁরা ঐতিহাসিক ভাবে একে অন্যের প্রতি যুযুধান।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ১৯৫৬ সালে বাবাসাহেব অম্বেডকর তাঁর বিখ্যাত আগরা বক্তৃতায় যে অভিমুখের কখা বলেছিলেন (‘‘শিক্ষিত হও, সংঘর্ষ করো, সংগঠিত থাকো’’), নানাবিধ সামাজিক শোষণের কারণে সেই পথে এগোতে পারেননি বাল্মীকিরা। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠেন মায়াবতী। সেই সময়ে জাঠভ-বাল্মীকি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ফাটল আরও গভীর হয়। ২০০৭ সালের বিধানসভা ভোটে মায়াবতী বহু-বিজ্ঞাপিত ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ আমদানি করে উচ্চবর্ণ, জাঠভ এবং মুসলিমদের এক মঞ্চে নিয়ে আসেন। কিন্তু টিকিট দেওয়া হয়নি বাল্মীকিদের।

বাল্মীকিদের সেই ক্ষোভকেই বিজেপি ২০১৪ থেকে কাজে লাগাতে শুরু করে। দলিত স্বার্থ নিয়ে আন্দোলন করা অনুপ শ্রমিক জানাচ্ছেন, বাল্মীকিদের সামনে মায়াবতী-লালিত জাঠভ দলিতদের খলনায়ক হিসেবে খাড়া করে মেরুকরণ শুরু করে বিজেপি। অনুপের কথায়, ‘‘পরপর বেশি কিছু নির্বাচনে মায়াবতী তথা বিএসপি-কে সমর্থন করা সত্ত্বেও যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা না-পাওয়া নিয়ে তীব্র হতাশা তৈরি হয় বাল্মীকিদের মধ্যে। তারা ঘেঁষতে শুরু করেন বিজেপির দিকে।’’

রামায়ণ রচয়িতা মহর্ষি বাল্মীকি তাঁদেরই সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন বলে গর্ব করেন বাল্মীকিরা। বহু কিংবদন্তি এবং আখ্যানের আড়ালে বিষয়টি এমনিতেই বিতর্কিত। কিছু দিন আগে কর্নাটকের লেখক কে এস নারায়ণচার্য একটি বইয়ে বাল্মীকিকে ব্রাহ্মণ পরিবারজাত বলে উল্লেখ করার পরে দলিত সমাজে আগুন জ্বলেছিল। বিতর্কের জেরে সরকার প্রথমে বইটিকে নিষিদ্ধ করে। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে বাল্মীকির জাত বিচারের জন্য ১৪ সদস্যের একটি কমিটি তৈরি হয়। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখে রিপোর্ট জমা দেবে, এমনটাই স্থির হয়। কিন্তু সে সবে উত্তরপ্রদেশের বাল্মীকি সম্প্রদায়ের বিশ্বাসে কোনও টাল খায়নি। রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মানুষই রামায়ণ লিখেছেন— এই বিশ্বাসকে আরও উস্কে দিয়েছে বিজেপি।

তাতে বাল্মীকিদের হিন্দুত্বের তারে বাঁধতেও সুবিধে হয়েছে সঙ্ঘ-বিজেপির।

রাজনীতিতে আসার পরে প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা এখন ফিরে পেতে চাইছেন দীর্ঘদিন আগে কংগ্রেসের সঙ্গে থাকা এই সম্প্রদায়কে। মায়াবতীও নিয়মিত নেতাদের পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার বাল্মীকি বসতিতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে একাসনে বসে খাওয়ার জন্য। বিজেপিও ‘রাম নাম’ চালিয়ে যাচ্ছে তাঁদের কানে।

কিছুটা রসিকতা করে রাজ্যের ওয়াকবিহাল শিবির বলছে— কংগ্রেস, বিজেপি এবং বিএসপি-র যা টানাপড়েন শুরু হয়েছে, তাতে বাল্মীকি না ফের রত্নাকর হয়ে যায়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement