রাজস্থানের লোকালয়ে হানা দিয়েছে পঙ্গপাল। ছবি: এএফপি
বিশাল সংখ্যার দলে দলে মানুষ, পাখি বা যে কোনও প্রাণীর ক্ষেত্রে ব্যাঙ্গার্থে ‘পঙ্গপাল’ শব্দের ব্যবহার জানা ছিল। কিন্তু প্রকৃত ছবিটা যে তার চেয়েও কতটা ভয়াবহ, সেটা বুঝতে পারছেন পশ্চিম ও মধ্য ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বাসিন্দারা। তার সঙ্গে এদের খাদ্যাভ্যাস, গতিপ্রকৃতি-সহ জৈবিক চরিত্র বিশ্লেষণ করলে আতঙ্কটা জাঁকিয়ে বসছে ক্রমেই। রাজস্থান, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় হানা দিয়েছে ইতিমধ্যেই। লাগোয়া দিল্লি, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশেও হানা দিতে পারে বলে ছত্তীসগঢ়েও জারি হয়েছে চূড়ান্ত সতর্কবার্তা। পরিযায়ী এই পতঙ্গবাহিনী বিঘের পর বিঘে ফসল নষ্ট তো করছেই, হানা দিয়েছে রাজস্থানের লোকালয়েও। ফলে পঙ্গপালের মেঘে অশনি সঙ্কেত দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
পঙ্গপাল কী?
এক কথায় বলতে গেলে পঙ্গপাল হল মরুপতঙ্গের দল। ছোট্ট শিংওয়ালা ঘাসফড়িং প্রজাতির এই পতঙ্গরা। রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও)-এর মতে অন্তত ১২টি প্রজাতির পতঙ্গ এই পঙ্গপাল শ্রেণিতে থাকে। গিরগটির মতো রং বদলাতে না পারলেও আবহাওয়া অনুযায়ী নিজেদের চরিত্র পাল্টে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে পঙ্গপালদের। আর ঝাঁকের হিসেব ধরলে এক বর্গকিলোমিটার থেকে কয়েকশো বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে একটি পঙ্গপালের দল। এফএও জানিয়েছে, এক একটি দলে চার কোটি থেকে আট কোটি পর্যন্ত পতঙ্গ থাকতে পারে। আবহাওয়া ও বায়ুপ্রবাহ অনুকূল থাকলে প্রতি দিন এই উড়ন্ত বাহিনী পাড়ি দিতে পারে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত।
পঙ্গপালের খাবার
মূলত মাঠের ফসল প্রধান খাদ্য হলেও বিভিন্ন রকম শস্যদানা এবং ফলও এরা খায়। এফএও-র মতে, এই পতঙ্গগুলি প্রতিদিন নিজের ওজনের সমান খাবার খেয়ে নিতে পারে। এক একটি পতঙ্গের ওজন হয় ২ গ্রামের মতো। সেই হিসেব ধরলে এক একটি পঙ্গপাল দিনে ২৫০০ থেকে ৩৫০০ হাজার মানুষের খাবার খেয়ে নিতে পারে এক দিনেই। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, এক দিনেই একটি পুরো গ্রামের খাবার খেয়ে নিতে পারে পঙ্গপালেরএকটি দল। তবে আশার কথা একটাই, এ বার অনেক আগেই হানা দিয়েছে এই পতঙ্গবাহিনী। এই সময় মাঠে বিশেষ ফসল নেই। রবিশস্য ঘরে তুলে ফেলেছেন চাষিরা। খরিফ মরসুমের ফসলের চাষ সে ভাবে শুরু হয়নি। মাঠে রয়েছে মূলত সব্জি ও ফল। মহারাষ্ট্রের কৃষি দফতরের ওয়ার্ধার জয়েন্ট ডিরেক্টর রবি ভোসলে সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে বলেছেন, ‘‘মাঠে ফসল না থাকায় পঙ্গপালের হানায় বিশেষ ক্ষতি হয়নি। তবে বেগুন-সহ অন্যান্য কিছু সব্জি এবং কমলালেবুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।’’
ভারতে অনুপ্রবেশ
সাধারণত সৌদি আরবের মরুভূমি এলাকায় বসবাস এই পঙ্গপালদের। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়ার পর থেকেই এরা ভারতের দিকে, অর্থাৎ উত্তরের দিকে যাত্রা শুরু করে। পৌঁছে যায় লোহিত সাগর অঞ্চলে। এই অঞ্চলের বৃষ্টিপাত এদের প্রজনন ও বসবাসের অনুকূল হয়ে ওঠে। তার পর লোহিত সাগর পেরিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। পাকিস্তান থেকে রাজস্থান হয়ে ঢুকে পড়ে ভারতে। প্রায় প্রতি বছরই অল্প পরিমাণে পঙ্গপালের হানার মুখোমুখি হয় পশ্চিম ও মধ্যভারতের রাজ্যগুলি। কিন্তু এ বছর বিপুল সংখ্যক পঙ্গপাল হানা দিয়েছে। তা ছাড়া সাধারণত জুলাই মাসে পঙ্গপাল হানা দিলেও এ বছর অনেক আগেই হানা দিয়েছে এরা। কারণ হিসেবে আবহবিদরা বলছেন, রাজস্থান-সহ ওই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে আগেই। ফলে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে অনেক আগে এবং বিপুল সংখ্যায় এ বছর হানা দিয়েছে পতঙ্গকূল।
আক্রান্ত রাজ্য
বর্তমানে রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে সক্রিয় এই পঙ্গপালের দল। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের মতে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই রাজ্যগুলি। এ ছাড়া দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগড়েও সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। আবহাওয়া দফতরের এক আধিকারিককে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, রাজস্থান থেকে মহারাষ্ট্রের অমরাবতী এবং মধ্যপ্রদেশের মান্ডলা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে পঙ্গপাল। এক থেকে দু’দিনের মধ্যেই ছত্তীসগঢ়েও পৌঁছে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ওই আধিকারিক। পাশাপাশি, সেন্ট্রাল ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট সেন্টার (সিআইপিএমসি) এই সব রাজ্যের কৃষি আধিকারিকদের সতর্কবার্তা দিয়েছেন এবং সাবধান থাকার কথা বলেছেন।
পরবর্তী সম্ভাব্য টার্গেট
কেন্দ্রীয় হাওয়া অফিসের কর্তারা জানাচ্ছেন, আবহাওয়া অনুকূল থাকলে রাজস্থান লাগোয়া রাজধানী দিল্লিতেও হানা দিতে পারে ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল। মৌসম ভবনের আবহবিজ্ঞানী কুলদীপ শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন, হাওয়ার অভিমুখ উত্তর-পশ্চিম দিকে রয়েছে। এই পরিস্থিতি থাকলে দিল্লিতে চলে আসা অসম্ভব নয়।
মানুষকে আক্রমণ করে না
প্রতিদিন নিজের ওজনের সমান খাবার জোগাড় করাটা কোনও প্রাণীর পক্ষেই সহজ নয়। তাই খাবার জোগাড় করাই এই পতঙ্গগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য থাকে। সেই কারণেই মানুষ বা অন্য কোনও প্রাণীকে আক্রমণ করে না এরা। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীন এফএও জানিয়েছে, পঙ্গপাল মানুষ বা অন্য কোনও প্রাণীকে আক্রমণ করেছে, এখনও পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই। আবার কোনও রোগ বহন করে আনে, এমন প্রমাণও পাওয়া যায়নি।
প্রতিকার
ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালকে পুরোপুরি দেশছাড়া করার উপায় নেই। তবে প্রচণ্ড জোর শব্দ করলে একটি জায়গা থেকে সামান্য সরানো যেতে পারে মাত্র। আর চাষের জমিতে দেওয়া যেতে পারে কীটনাশক। কেন্দ্রীয় কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চাষিরা ম্যালাথিয়ন, ফেনভালেরেট, কুইনালফসের মতো কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন। মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের চাষিরা আবার রাসায়নিক ও জল স্প্রে করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।