Lockdown

বাজার খুললেও ভবিষ্যৎ‌ ভয়ের, কারণ লকডাউনটা সঙ্কটের শিকড় নয়

করোনার চিকিৎসা দূরে থাক, কাল পকেটে বাজারের টাকা থাকবে তো? রাজনৈতিক নেতারা অনেকে বলছেন, এই আশঙ্কা করোনার দান।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২০ ১৬:১৩
Share:

বাজার খুলছে। ফাইল চিত্র।

করোনা রইল। রয়ে গেল ঝড়ের মারণ কামড়, পেটের টান আর বাজারের আরও বড় ছোবলের আশঙ্কা। আর এ সব নিয়েই আজ, সোমবার থেকে খোলা হাওয়া। মুক্ত জীবন! স্বাভাবিক! আমরা জানি অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের নায়ক মানেই সে মৃত্যুর সঙ্গে হেলায় পাঞ্জা লড়তে পারে। আজকের এই নতুন ‘স্বাভাবিক’-এ রাষ্ট্রের দেওয়া ব্যাখ্যায় আমরা সবাই কি এখন ওই অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের নায়কের মতোই? বোধহয় না। মুখে মাস্ক আর মনে আশঙ্কা ‘বাঁচব তো(!)’ নিয়ে নায়ক থাকা সম্ভব নয়।

Advertisement

কিন্তু তার থেকেও বড় আশঙ্কা, করোনার চিকিৎসা দূরে থাক, কাল পকেটে বাজারের টাকা থাকবে তো? রাজনৈতিক নেতারা অনেকে বলছেন, এই আশঙ্কা করোনার দান। কিন্তু দুর্গতরা জানেন— রান্নাঘরের আঁচ মার্চের আগেই তেজ হারাতে শুরু করেছিল। করোনা তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে মাত্র। করোনা না হলেও আমাদের অর্থনীতি গত আর্থিক বছর শেষ করেছে বেশ নড়বড়ে ভাবেই। এবং করোনা না হলেও, অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা ছিল, কেন্দ্রীয় আর্থিক নীতির প্রকৃতি না বদলালে এই পতন আরও দীর্ঘমেয়াদি হবে। এর কারণ অন্য আলোচনা দাবি করে। আমরা বরং ফিরি করোনার আগের আর্থিক পরিস্থিতিতে।

রাজনৈতিক স্লোগানে নিজেদের হারিয়ে ফেলার আগে মার্চে প্রকাশিত সরকারি তথ্যে চোখ রাখা যাক। মাথায় রাখতে হবে, ২৫ মার্চ থেকে আমরা দরজা বন্ধ করে নিভৃতবাস মেনে নিয়েছি। অর্থাৎ, গত বছরের মাত্র কয়েকটি দিন দেশের বাজারে লেনদেন হয়নি। সরকারি তথ্যই বলছে— গোটা বছর ধরেই দেশের বৃদ্ধি কমেছে। কারণ আমরা সবাই খরচ কমিয়েছি। তাই বাজারে চাহিদা কমেছে।

Advertisement

জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমাদের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩.১ শতাংশ— গত ১১ বছরের হিসাবে এটি রেকর্ড কম অর্থাত্‌ সর্বনিম্ন। গোটা বছরের বৃদ্ধির হার যদি মাথায় রাখি, তা হলে তা দাঁড়িয়েছে ৪.২ শতাংশে। ২০১৮-১৯ সালে এই হার ছিল ৬.১ শতাংশ। এটা মাথায় রাখতে হবে যে মার্চের এই তথ্যের এদিক-ওদিক হতে পারে, কারণ বছর শেষের আগেই প্রকাশিত এই অঙ্কের একটা অংশ অনুমানের উপর নির্ভরশীল। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, সব তথ্য এলে এই বৃদ্ধির হার আরও একটু কমতে পারে। তাঁদের ভাষায় এই পতন সেকুলার বা যা দীর্ঘমেয়াদি। মানে কোনও হঠাৎ হওয়া চাপ নয়, যা মিটে গেলেই খুব তাড়াতাড়ি বাজার আবার ফিরবে বৃদ্ধির রাস্তায়। যে চাপে বাজার আছে, তাতে করোনার ছায়া না থাকলেও বাজারের ডোবা অব্যাহত থাকত।

আরও পড়ুন: সবাই জানে সীমান্তে কী হচ্ছে, লাদাখের ইঙ্গিত করে অমিতকে কটাক্ষ রাহুলের

তথ্যে চোখ রাখলে গল্পটা বুঝতে সুবিধা হবে। সরকারের আয়ের মূল সূত্র আমাদের দেওয়া কর। সরকারকে বছরের প্রথমেই আন্দাজ করতে হয় কত টাকা আয় হবে। আর তার উপর নির্ভর করেই খরচের হিসাব করতে হয়। আয় আর ব্যয়ের ফারাক মেটাতে সরকার ধার করে। আমার আপনার মতোই। বাজেটে ফিসক্যাল ডেফিসিট বা রাজকোষ ঘাটতির অঙ্কই বলে দেয় সরকার কত ধার করেছে।

২০১৯ সালে কেন্দ্রের অঙ্কে প্রয়োজন ছিল ৭ লক্ষ ৩ হাজার ৭৬০ কোটি টাকার ঘাটতি বা নিট ঋণের। সেটা পরবর্তীতে দাঁড়ায় ৭ লক্ষ ৬৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকায়। তার পর আরও ধারের প্রয়োজন হয়। আর তা বেড়ে দাঁড়ায় জিডিপি-র ৪.৬ শতাংশে। অথচ ভাবা হয়েছিল এটা ৩.৮ শতাংশের মধ্যেই থাকবে।

আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৯৯৮৩, মোট আক্রান্তে শুধু মহারাষ্ট্রই টপকে গেল চিনকে

অঙ্কটা কিন্তু সোজা। বাজার ভাল হলে, বিক্রিবাটা ভাল হলে শুধু ব্যবসায়ীর নয়, সরকারেরও ভাল হয়। যত বিক্রি তত কর, নানান সূত্রে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই সরকারের ধারণা আর বাজারের গতিপ্রকৃতি চোর-পুলিশ খেলে চলেছে। আর জিতছে বাজারই। বাজারে চাহিদা না থাকায়, বিক্রিবাটা কমছে বেশ কিছু দিন ধরেই। আর তার ল্যাজ ধরেই কমছে জিডিপি ও সরকারের আয়। কিন্তু সরকার যে খরচের জন্য দায়বদ্ধ তা তো করতেই হবে, আয় কমলেও! নিন্দুকে অবশ্য কেন্দ্রের খরচের চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু ওই রাস্তায় আমরা এখন হাঁটব না। সিআইআইয়ের হিসাবে ২০১৯-২০ সালে কৃষি আর সরকারের চাহিদাই টিঁকিয়ে রেখেছিল অর্থনীতিকে। উৎপাদন থেকে শুরু করে বাকি সব ক্ষেত্রই ছিল ম্রিয়মান।

অর্থাৎ, এক নজরে দেশের বাজার কিন্তু করোনা ছাড়াই বেশ নড়বড়ে ছিল। এবং আরও নড়বড়ে হতে যাচ্ছিল। এ বার কী হবে? এই মুহূর্তে খুব একটা আশার আলো কেউই দেখছেন না। রাজনৈতিক স্লোগান যাই বলুক না কেন, আমাদের জীবন দিয়ে জানি এই মুহূর্তে ম্যাজিক ছাড়া অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। সিআইআইয়ের নব নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ও কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর উদয় কোটাক বাজার সম্বন্ধে জানবেন না তা শুধু নির্বোধই ভাববে। তাঁর গলায়ও যে খুব একটা আশার সুর বাজছে এমন নয়। কর্মভার নিয়েই তিনি বলেছেন, অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনও আলোচনার অবকাশ নেই। তিনি সরকারের কোষাগার নিয়েও আশাবাদী নন। এবং একই সঙ্গে বলেছেন, “বাজার খুললেই একটা চাহিদার ঝড় দেখব। কারণ তিন মাসের চাহিদা বাজারে এসে পড়বে। কিন্তু তা হবে সাময়িক।” তাঁর বক্তব্য, এর থেকে বাজারের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেখাটা ভুল হবে। রাহুল বাজাজ থেকে উদয় কোটাক— সবারই কথায় কিন্তু একই দুশ্চিন্তার প্রকাশ।

সরকারি নীতি নিয়ে রাহুল গাঁধীর মতো বিরোধীরা তো সমালোচনা করবেনই! অর্থনীতিবিদদেরও বাজার পরিচালনা নিয়ে নিজেদের একটা ধারণা থাকেই। অমর্ত্য সেন, অভিজিত্‌ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বা রঘুরাম রাজনের আশঙ্কাও সেই দিক থেকে না হয় কানে নিলাম না! কিন্তু শিল্পপতিরা চট করে সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না। তাই যখন রাহুল বাজাজ বা উদয় কোটাকের মতো শিল্পপতিও আশঙ্কিত থাকেন, তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা কী আশায় বাঁচব? বিশেষ করে অঙ্ক যখন বলছে আশঙ্কাটা ঠিকই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement