কাশী বিশ্বনাথ ধামের এই ছবি টুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
রাজসূয় যজ্ঞ চলছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ঘিরে। তার একেবারে হাতে গরম অনুভূতি পেতে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে একটি হোটেলে উঠে এলাম, প্রান্তিক আস্তানাটি পরিত্যাগ করে। নীচের ডাইনিং-এ টোস্ট দিয়ে চা খেতে খেতে দেখলাম, জনা বারো বাঙালির জমিয়ে আড্ডা। দলের এক জন আবার ওই হোটেলে বসেই ফেসবুক লাইভ করছেন, ‘রিয়াল’ ভিড়ের উত্তেজনা ‘ভার্চুয়াল’ ভিড়ে সঞ্চারিত করতে চেয়ে।
খুব পরিশ্রম করতেও হচ্ছে না তার জন্য। চৌরাস্তার মাথায় দুটো জায়ান্ট স্ক্রিনে প্রতি পল ভেসে উঠছে মন্দিরের ভিতরের পূজার দৃশ্য থেকে প্রধানমন্ত্রীর আগমনের প্রতিটি অনুপুঙ্খ।
চা শেষ করে রাস্তায় গিয়ে টের পেলাম, ফেসবুক লাইভে বার বার করে যে শব্দগুলো বাংলায় উচ্চারিত হচ্ছিল, ভিড়ের ভিতর থেকেও তা-ই উঠে আসছে হিন্দিতে—‘ভোল বদলে দিয়েছে, কাশীর পুরো ভোল বদলে দিয়েছে’!
হঠাৎই হইচই উঠল একটা। তাকিয়ে দেখি দুটো জায়ান্ট স্ক্রিনের একটায় এবিপি নিউজ়-এর এক্সক্লুসিভ—‘কালভৈরব মন্দিরে পা রাখলেন প্রধানমন্ত্রী’।
কাশীর কোতোয়াল কালভৈরব, বিশ্বনাথ দর্শনের আগে কালভৈরব দর্শন অবশ্যকর্তব্য। সময় যে মানুষের হাতে নয়, স্মৃতির স্মরণিকায় যা থাকে, তার চাইতে অনেক অধিক থেকে যায় কালের সঞ্চয়ে, কালভৈরব তাই মনে করিয়ে যান অহরহ। রবিবার বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিতে যাবার আগে ওঁর কাছে যাবার কথা ভুলে গেলাম কী করে?
নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে সামান্য সান্ত্বনাও দিলাম। ভোলবদলের সময় এমনটা হয় বলে। সত্যিই তো, গলির পর গলি ভেঙেচুরে এরকম চওড়া রাস্তা, গঙ্গার ঘাট থেকে সোজা মন্দিরে চলে আসার সুবিধা, ওয়ান লেন-এর বদলে ফোর লেন বারাণসী আগে দেখেনি। বিশ্বনাথ মন্দির শিখরে সোনা ছিল, কিন্তু প্রাত্যহিক জীবন বড়ই মলিন ছিল প্রাচীনতম শহরের। সেই দিনগত পাপক্ষয়ের গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন কাশীর নতুন দিগন্তে হাসি নিয়ে, বাঁশি নিয়ে আসার এই মাহেন্দ্রক্ষণই তো ভুলে যাওয়ার আদর্শ সময়।
আর সব ভুলে গেলেও কবিতা ভোলা যায় না। ঈশান কিংবা নৈঋত থেকে তার এক-একটি পঙ্ক্তি বহুযুগের ওপার থেকে এসে ফুলকি জ্বালায়। এখনও জ্বালাল। কেবলই মনে পড়তে লাগল, ‘আঃ পাথর আমি বিগ্রহ মানি না/...কিন্তু তুমি এত রক্ত পেলে কোথায়?’ শিবরাত্রির উপোস খুব কঠিন, চব্বিশ-ছাব্বিশ ঘণ্টা নির্জলা থেকে চন্দ্রচূড়কে দুধ-দই-ঘি-মধু-চিনি মাখাতে মাখাতে আমার মনে হত, রক্তও থাকে বিগ্রহের শিরা-উপশিরায়?
উত্তরহীন প্রশ্নের পৃথিবীতে, কাশীর শতকের পর শতক পেরনো মন্দিরগুলো কোথায় আছে, যদি একটু দেখি! আলাইপুরার মড়িঘাটের কাছে, বেণীমাধব ঘাটের আরও উত্তরে, ঔসনগঞ্জের গলি-উপগলি পেরিয়ে চৈতপুরার কাছে কিংবা মৈদাগিন ছাড়িয়ে সিদ্ধিদাত্রীর গলিতে, মন্দিরের পর মন্দির। যেখানে দু'জন মানুষ পাশাপাশি পথ চলতে পারে না, সেখানে কে এসে প্রতিষ্ঠা করল মন্দির? কাশী বিশারদদের লেখায় পাই, আমার বাবার শিক্ষক শ্রীজীব ন্যায়তীর্থের মুখেও শুনেছি, নির্বিচার আক্রমণ থেকে বিগ্রহদের রক্ষা করার জন্য পূজারিরা তাঁদের নিজের-নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। মন্দিরগুলো চুরমার হয়ে যাওয়ায় বিগ্রহরা আর সেখানে ফিরে যেতে পারেননি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রানি অহল্যাবাই হোলকার ধ্বংসপ্রাপ্ত কাশীর মন্দিরের পুনর্নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন। কিন্তু দেবতারাও মানুষেরই মতো, উদ্বাস্তু হয়ে যেখানে এসেছেন তাকেই ঘর করে নিয়েছেন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে কাশীর অনেক-অনেক বাড়িই বিগ্রহদের মতিঝিল কলোনি কিংবা বিদ্যাসাগর উপনিবেশ। মানুষের দেওয়া জায়গায়, মানুষেরই মতো থেকে গেছেন তাঁরা। কিন্তু বড় দেবালয়, বড় রাস্তায় ‘ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা’ হারিয়ে গেলে? দেবতার ইতিহাসই তো দেবতার শিরা-উপশিরায় বহতা রক্ত!
আজ নৌকা চলাচল বন্ধ বারাণসীর গঙ্গায়। রবিবার অনেক রাত অবধি পিন্টু মাঝির নৌকায় চক্কর কাটা গেল। ডিজেল আক্রা, পিন্টুর রোজগার কমতির দিকে, শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল বিশ বছর আগের কাশীতে প্রায় সবই ছিল হাতে টানা নৌকা। মাঝির পাশে বসে যাত্রীও টানত মন করলে।
হাতে বাওয়া নৌকা, ঘরের বাসিন্দা ঈশ্বর এখন তামাদি, বারাণসীতে সবই ইদানীং লার্জ স্কেলে। রাত দশটার কাছাকাছি মণিকর্ণিকায় ভিড়ল নৌকা। যৌবনে খুব সাধ ছিল কাশীতে মরব, কিন্তু মণিকর্ণিকায় চিতার পাশে দাঁড়িয়ে দু’জনকে সেলফি তুলতে দেখে গা গুলিয়ে উঠল।
আর ওই অবস্থাতেও ফিরে এল একটি কবিতার পঙ্ক্তি, ‘ধ্বংসের কিনারা গাঁথা জীবন পাথর হল তার সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়া’!
ধ্বংসের আভিজাত্যই জীবনকে পাথর, পাথরকে বিগ্রহ করে তোলে।
লয়ের বেদনা অন্তরে ধারণ না করলে সৃষ্টির উচ্ছ্বাস ফিকে হয়ে যায়।
সতীর ভার কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখলে নটরাজ প্রলয় নাচন নাচবেন কী ভাবে?