Kiss Controversy in Indian Politics

হিংসা থেকে রাজনীতি চুম্বনে! নানা রাজ্যের ওষ্ঠ ছুঁয়েছে চুমু-বিতর্ক, বাংলার তরুণ তুর্কিরা কী বলছেন?

দেশের রাজনীতিতে কি চুম্বন-বিতর্ক কি এই প্রথম? সাম্প্রতিক সময়ে তাকালে দেখা যাচ্ছে, ‘চুম্বন’ বার বার রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজ্যে। কখনও দিল্লি, কখনও ঝাড়খণ্ড, কখনও বা মধ্যপ্রদেশ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৩ ১৯:৫৩
Share:

বুধবার সংসদে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে উড়ন্ত চুম্বন ছোড়ার অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

এক যুবনেত্রী বলছেন, ধর্মের নামে কেউ কাউকে মেরে ফেললে আপত্তি নেই! কিন্তু চুমুতে আপত্তি! এক যুবনেতা বলছেন, গণতন্ত্রের মন্দিরে এ সব না-হওয়াই ভাল। আর এক যুবনেতা বলছেন, এ সব বিতর্ক তৈরি করে নজর ঘোরানোর চেষ্টা।

Advertisement

প্রসঙ্গ: বুধবার লোকসভায় অনাস্থা বিতর্কের সময় রাহুল গান্ধীর ‘ফ্লাইং কিস’। ইতিমধ্যেই বিজেপির মহিলা সাংসদেরা যা নিয়ে স্পিকারের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগ, অনাস্থা বিতর্কে ভাষণ শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রাহুল বিজেপির মহিলা সাংসদদের দিকে উদ্দেশ করে উড়ন্ত চুম্বন ছুড়েছেন। যা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি।

ঘটনাচক্রে, যদিও সেই অভিযোগের সাপেক্ষে স্পষ্ট কোনও প্রমাণ বিজেপি পেশ করতে পারেনি। অন্তত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। রাহুল উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ছেন, সেই মর্মে কোনও ছবি এখনও পর্যন্ত মেলেনি।

Advertisement

২১ জুলাই তৃণমূলের সমাবেশে ‘চমক’ ছিল তরুণী রাজনীতিক রাজন্যা হালদারের বক্তৃতা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিজেপি এমন একটি রাজনীতি আমদানি করেছে, যেখানে রাস্তায় ধর্মের নামে এক জন অন্য জনকে খুন করলে তাদের অসুবিধা নেই। কিন্তু চুম্বন বা আলিঙ্গনে আপত্তি! বুধবার রাহলের বক্তৃতার সময়ে বিজেপি বার বার বাধা দিচ্ছিল। তাঁর কথার জবাব দিতে না পেরেই অযথা বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে।’’ রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র তথা তরুণ নেতা রাজর্ষি লাহিড়ী অবশ্য বলেন, ‘‘ফ্লাইং কিস নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু সব কিছুর একটা জায়গা থাকে। কেউ নিশ্চয়ই ঠাকুরঘরে রান্না করবেন না! সংসদ গণতন্ত্রের মন্দির। সেখানে এই ধরনের আচরণ কাম্য নয়।’’ আবার সিপিএমের নতুন প্রজন্মের অন্যতম মুখ দীপ্সিতা ধরের বক্তব্য, ‘‘রাহলের সস্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তার কোনও ছবি বা ভিডিও দেখা যায়নি। তা ছাড়া, যিনি বুধবার লোকসভায় দাঁড়িয়ে অত কথা বললেন, সেই স্মৃতি ইরানি এক বারও মণিপুরের মহিলাদের হয়ে কথা বলেননি! এক বারও গলা চড়াননি ওঁর সতীর্থ সাংসদ কুস্তিকর্তা ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে। এ থেকেই বোঝা যায়, বিজেপির উদ্দেশ্য কী।’’ আর যুব কংগ্রেস নেতা আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘ওরা (বিজেপি) রাহলকে ভয় পায়। রাহুল গান্ধীর ভালবাসার দোকানের সামনে ওদের ঘৃণার সামগ্রী ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তাই বিতর্ক তৈরি করে আসল ঘটনা থেকে নজর ঘোরাতে চাইছে বিজেপি।’’

কর্নাটক বিধানসভা ভোটে বিজেপির পরাজয়ের পরে রাহুল বলেছিলেন, ‘‘বিজেপির ঘৃণার দোকান বন্ধ হয়েছে। মানুষের ভালবাসার দোকান খুলে গিয়েছে কন্নড়ভূমে।’’ সেই কর্নাটক, পাঁচ বছর আগে যেখানে বক্তৃতায় ‘‌মোদী’ পদবিকে অবমাননার অভিযোগে রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ হয়ে গিয়েছিল। যা তিনি সম্প্রতি ফেরত পেয়েছেন। তার পরেই লোকসভায় বক্তৃতা করেছেন।

কিন্তু সেই বক্তৃতার অভিঘাতকে ছাপিয়ে গিয়েছিল রাহুলের ‘ফ্লাইং কিস’ বিতর্ক। অন্তত শাসক বিজেপির তরফে তেমনই চেষ্টা করা হয়েছিল।

কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে চুম্বন নিয়ে বিতর্ক কি এই প্রথম? তা নয়। সাম্প্রতিক কালে ‘চুম্বন’ বার বার রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজ্যে। কখনও দিল্লিতে, কখনও ঝাড়খণ্ডে, কখনও বা মধ্যপ্রদেশে। কোনও রাজ্যে উত্তাল হয়েছে বিধানসভা, কোথাও আবার নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যেমন ঘটেছিল ঝাড়খণ্ডে। সেখানে তখন বিজেপির সরকার। সাঁওতাল পরগনার হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার দুই বিধায়ক সিমন মারান্ডি এবং স্টিফেন মারান্ডি পাকুড়ে ‘চুম্বন প্রতিযোগিতা’র আয়োজন করেছিলেন। আদিবাসী যুগলেরা তাতে নাম দিয়েছিলেন। কোন যুগল বেশি ক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে পারে— এই ছিল প্রতিযোগিতার বিষয়। দেখা গিয়েছিল, একটি খোলা মাঠে কয়েকশো যুগল পরস্পরকে চুম্বন করছেন। ওই ঘটনায় পর দিন উত্তাল হয়েছিল ঝাড়খণ্ড বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশন। বিজেপি দাবি করেছিল, দুই জেএমএম বিধায়ক সিমন এবং স্টিফেনকে সাসপেন্ড করতে হবে। দফায় দফায় মুলতুবি হয়ে যায় বিধানসভার অধিবেশন। বিজেপির বক্তব্য ছিল, পাকুড়ে যা ঘটেছে, তা মহিলাদের অসম্মান এবং ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। চাপে পড়ে দল থেকে দুই বিধায়ককে সাসপেন্ড করেন জেএমএম প্রধান শিবু সোরেন। বেশ কিছু দিন চুম্বন বিতর্কে আবর্তিত হয়েছিল বাংলার পড়শি রাজ্যের রাজনীতি।

২০২০ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছিল ‘আ স্যুটেবল বয়’ শীর্ষক ওয়েব সিরিজ়। তার একটি দৃশ্যে মধ্যপ্রদেশের মহেশ্বর শহরের এক প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের প্রাঙ্গণে এক যুগলকে চুম্বনরত দেখানো হয়েছিল। একে মন্দিরে চুম্বন। তার উপর ছবিতে দেখানো হয়েছিল, যুবকটি মুসলিম এবং যুবতীটি হিন্দু। হিন্দুত্ববাদীদের ‘ভাবাবেগ’-এ আঘাত লেগেছিল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপি সরব হয়েছিল নেটফ্লিক্সকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে। ইনদওরে একটি বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির তৎকালীন পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়কেও। মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘‘এই সিরিজ়ের কিছুই আমার স্যুটেবল লাগেনি! উচিত মনে হয়নি।’’ মধ্যপ্রদেশ পুলিশকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা নিয়ে ভোপাল থেকে জব্বলপুর তপ্ত ছিল বেশ কিছু দিন। সেই ঘটনার আঁচ পড়েছিল উত্তরপ্রদেশেও। তার পরে অবশ্য সময়ের নিয়মেই তা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গিয়েছে।

সম্প্রতি দিল্লি মেট্রো ঘিরে বিতর্ক বেধেছিল। দেখা গিয়েছিল, রাজধানীর মেট্রোয় কখনও বিকিনি পরে সওয়ার হচ্ছেন তরুণী, তো কখনও চুম্বনে মত্ত কোনও যুগল। পর পর এমন ঘটনায় অস্বস্তিতে পড়ে যান দিল্লি মেট্রো কর্তৃপক্ষ। তার পরেই সমস্ত রুটের মেট্রোয় কামরার ভিতরে উর্দিধারী পুলিশ এবং সাধারণ পোশাকের নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই ধরনের ঘটনা রুখতে ইতিমধ্যেই স্টেশনগুলিতে এবং মেট্রোর ভিতরে পুলিশ মোতায়েন করার কথা দিল্লি পুলিশকে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ।

এ কথা ঠিক যে, প্রকাশ্যে ‘চুম্বন’ নিয়ে পশ্চিমি দেশগুলি যতটা খোলামেলা, ভারত এখনও ততটা নয়। তবে গান, ছবি বা সাহিত্যে চুম্বন নিয়ে আড়ষ্টতা আগের মতো নেই। কিন্তু এখনও অনেকের অভিমত, সাহিত্য বা সিনেমায় যা হয়, তার সবটাই বাস্তবে করা যায় না। সে কারণেই রাহুলের ‘ফ্লাইং কিস’ নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement