কাজিরাঙায় বিহু শিল্পীদের সঙ্গে ব্রিটেনের রাজদম্পতি। মঙ্গলবার উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি।
‘দিল্লি টু ডিফলু’।
সকাল থেকেই কাজিরাঙা সরগরম। রানি এলিজাবেথের নাতি, নাতবৌ ঘুরতে আসছেন বলে কথা।
আজ দুপুরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেছিলেন কেমব্রিজের ডিউক ও ডাচেস। সন্ধেয় কাজিরাঙার অরণ্য লাগোয়া ডিফলুতে পৌঁছনোর পর নৈশাহারে তাঁরা খেলেন বিহুর খাবার। এ ভাবেই দু’দিনের কাজিরাঙা সফর শুরু হল প্রিন্স উইলিয়াম আর প্রিন্সেস ক্যাথরিন ওরফে কেটের।
বিধানসভা ভোট শেষ হয়েছে সদ্য। দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে বিহু। এমন উৎসব-মোহনায় ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের দুই সদস্য অসমে রাজকীয় অভ্যর্থনা পাবেন, তা জানাই ছিল। কেট আর উইলিয়ামের সামনে বিহু, ঝুমুর নাচ দেখানোর জন্য কয়েক দিন ধরেই হাতিখুলি, ডিফলুতে চলছিল অনুশীলন। এ দিন সকালে ‘ডিফলু রিভার লজে’ চূড়ান্ত মহড়ার পর শুরু হয় অপেক্ষা। বিকেলে বিশেষ বিমানে তেজপুর পৌঁছন উইলিয়ামরা। কেটের পরনে ছিল পেস্তা রঙের গাউন। কালো স্যুটে ছিলেন উইলিয়াম। সেখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও তাঁর স্ত্রী ডলি গগৈ। তেজপুর বিমানবন্দরের সামনেও বিহু-ঝুমুর-সত্রীয় নাচে অতিথিদের স্বাগত জানানো হয়।
তেজপুর থেকে কনভয়ে ঘণ্টাদেড়েকের পথ পেরিয়ে সন্ধেয় কাজিরাঙার বাগরি রেঞ্জে পৌঁছন উইলিয়াম দম্পতি। ঢোল-পেপা-গগনার সুর-তালে তাঁদের স্বাগত জানানো হয়। এক দিকে চা বাগান, অন্য দিকে জাতীয় উদ্যানের গভীর অরণ্য। পাঁচতারা বিলাস না থাকলেও জঙ্গলঘেঁষা রিসর্ট দেখে খুশিই হন ডিউক ও ডাচেস।
খানিক বিশ্রাম ও বিহুর পিঠে, নাড়ুর আপ্যায়ন সেরে সন্ধে সাতটা নাগাদ তাঁরা ক্যাম্প-ফায়ারের পাশে বসেন নাচ দেখতে। ব্রিটিশ হাইকমিশন তরফে জানিয়েছিল, স্থানীয় চা বাগানের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে চান রাজপুত্র ও তাঁর স্ত্রী। তাই কুঠরি ও হাতিখুলির মেয়েরাই তাঁদের বিহু ও ঝুমুর নাচ দেখান। নাচের তালে দুলে ওঠেন কেটও।
বিহু দেখতে দেখতেই উঠে এলেন উইলিয়াম। সাদা জামা আর ক্রিম রঙা প্যান্টের রাজপুত্র কাছে এগিয়ে আসতেই বুক ঢিপঢিপ লাল পাড়, সাদা শাড়ির মেয়েদের দলটার। দোভাষীর সাহায্যে জানতে চাইলেন, দু’টো বাঁশের ছোট টুকরো দিয়ে কেমন করে মজাদার সুর বেরোচ্ছে? শুধু শুনে সাধ মেটেনি। সামনের মেয়েটির খোঁপায় গোঁজা ‘গগনা’ চেয়ে নিলেন রাজপুত্র। বিহুর অন্যতম অঙ্গ গগনা বাজানোর চেষ্টা করেও বিফল হলেন প্রথম বার। এর পর অন্য মেয়েদের দেখিয়ে দিতে বললেন। কয়েক বারের চেষ্টায় বেজে উঠল গগনা। খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলেন উইলিয়াম। নাচ শেষে লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছোট্ট ছাত্রী বাবলি দেবী, কস্তুরি উপাধ্যায়দের কাছে টেনে নিলেন ‘অ্যানা সুই’য়ের শিফন ও টুইলের তৈরি ৮২০ ডলার মূল্যের ম্যাক্সি গাউনে সজ্জিতা কেট। কানে শ্যান্ডেলিয়ার দুল। কচি বিহুবতীদের নাম, স্কুলের নাম জানতে চাইলেন। গাল টিপে আদরও করলেন। এর পর কেটের চোখ গেল তিন বছরের কচি ঢোল বাজিয়ের দিকে। আদর করে নাম জানতে চাইলেন। সে কি বুঝল কে জানে! দিব্য তার পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল কেটের ‘ডিউন লন্ডন’-এর ৬০ পাউন্ড দামের জুতো। তাতে অবশ্য পরোয়া না করে মুখের হাসি বজায় রাখলেন ডাচেস। স্বামী-স্ত্রী তাঁকে আদর করে বললেন, “ইউ আর ভেরি এনার্জেটিক।”
হাইকমিশনের তরফে কেটের সঙ্গিনী রঞ্জিনী ফুকন জানান, বাচ্চা বিহু নাচিয়েদের দেখে কেটের নিজের সন্তান দু বছরের জর্জ আর এক বছরের শার্লটের কথা মনে পড়ছিল।
ডিফলু রিভার লজের তরফে আশিস ফুকন জানান, বিহুর সময়ে অসমে আসায় কেট ও উইলিয়ামের নৈশাহারের মেনুতে ছিল অসমীয় খাবার— অমিতা খার (পেঁপের সুস্বাদু ঘ্যাঁট), আলু পিটিকা (আলু সিদ্ধ চোখা), পাতোত দিয়া মাস (কলাপাতায় ভাপা মাছ), সুঙাত দিয়ে সাগোলি মাংখ (বাঁশের চোঙায় পোড়ানো ছাগলের মাংস), মাসোর টেঙা (মাছের টক ঝোল), পিঠে, পায়েস। সেই সঙ্গে উত্তর ভারতীয়, কন্টিনেন্টাল এবং পশ্চিমী খাবারও ছিল। লজের কর্মীরা পরে জানান, অসমীয়া খাবার খেয়ে বেশ খুশি হয়েছেন দু’জন। চা বাগানের মেয়েদের সঙ্গে এবং লজের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও চালিয়েছেন দোভাষীর মাধ্যমে।
কেট ও উইলিয়াম পরে জানান, মাটি ও অরণ্যের কাছাকাছি লোকসংস্কৃতির মধ্যে দারুণ সন্ধ্যে কাটল।
আগামিকাল সকালে তাঁরা বাগরি রেঞ্জে জিপ সাফারি করবেন। অসম সরকার প্রথমে হাতি সাফারির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ডিউক ও ডাচেস জানিয়ে দেন, হাতি সংরক্ষণের বার্তা দিতেই তাঁরা কাজিরাঙা আসছেন। তাই হাতির পিঠে চড়ে মোটেই ঘুরবেন না। রাজ-সফরের সময় বাগরিতে আম-জনতার প্রবেশ বন্ধ রাখা হচ্ছে। সাফারির পরে কেট ও উইলিয়াম বনকর্তা ও বনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে কাজিরাঙার প্রাণী সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জানবেন। তার পর তাঁরা যাবেন ডব্লিউটিআই পরিচালিত কাজিরাঙা পশু উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ঘুরে দেখবেন ডাচেস অফ কর্নওয়ালের ভাই প্রয়াত পশুপ্রেমী মার্ক শ্যান্ডের ‘এলিফ্যান্ট ফ্যামিলি’র উদ্যোগে তৈরি ‘কাজিরাঙা ডিসকভারি সেন্টার’ ও হাতি ক্লিনিক।
আগামী এক দশকের মধ্যে ২০ মিলিয়ন পাউন্ড সংগ্রহ করে ভারতের ১০০টি হাতি চলাচলের রাস্তা সুরক্ষিত করতে লন্ডনে হাত মিলিয়েছে বিশ্বের পাঁচটি পশুপ্রেমী সংগঠন। গত বছর জুলাইয়ে লন্ডনে রাজকুমার চার্লস ও ক্যামিলা এবং ইংল্যান্ডে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত রাজন মাথাইয়ের উপস্থিতিতে ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চার্লস নিজে হাতি সংরক্ষণে অত্যন্ত আগ্রহী। গত বছর নভেম্বরে কাজিরাঙায় ডব্লিউআইয়ের হাতি ক্লিনিক উদ্বোধনে এসেছিলেন রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ স্যার এভেলিন রথ্সচাইল্ড। সেই হাতি সংরক্ষণের সূত্র ধরেই উইলিয়ামের কাজিরাঙা সফর।
হাতি চলাচলের রাস্তা ছেড়ে দিতে কার্বি আংলংয়ের রাম টেরং গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের গোটা বসতি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। সেই গ্রামবাসীদের সঙ্গেও কথা বলবেন কেট ও উইলিয়াম। খুঁটিয়ে জানবেন ওই কেন্দ্রে পশু উদ্ধার ও সংরক্ষণের খুঁটিনাটি।