ছবি: সংগৃহীত।
জম্মুর কাঠুয়ায় যাযাবর বকরওয়াল সম্প্রদায়ের বালিকার গণধর্ষণ ও খুনের মামলার রায়ে সন্তুষ্ট নন বালিকার বাবা-মা ও সরকারি আইনজীবীরা। সরকারি আইনজীবী এস এস বসরা জানিয়েছেন, তাঁরা হাইকোর্টে আপিল করবেন।
২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি বকরওয়াল সম্প্রদায়ের ওই বালিকা নিখোঁজ হয়। পরে জম্মুর হিরানগর থানায় এফআইআর করেন তার বাবা। জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের চার্জশিট অনুযায়ী, ওই বালিকাকে অপহরণ করে কাঠুয়ার একটি মন্দিরে আটকে রাখে ওই মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক সাঞ্জী রাম, তার ছেলে বিশাল জনগোত্র, রামের এক নাবালক ভাইপো, রামের বন্ধু পরভেশ কুমার ও রাজ্য পুলিশের স্পেশ্যাল অফিসার দীপক খাজুরিয়া। চার দিন তাকে মাদকের প্রভাবে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়। পরে গণধর্ষণ করে পাথর দিয়ে থেঁতলে খুন করা হয়। রাজ্য পুলিশের আরও তিন কর্মী আনন্দ দত্ত, তিলক রাজ ও সুরেন্দ্র বর্মা ঘুষ নিয়ে প্রমাণ লোপে সাহায্য করে। পুলিশ চার্জশিটে জানায়, বকরওয়াল সম্প্রদায়কে জম্মু থেকে তাড়াতেই এই ছক কষেছিল অভিযুক্তেরা।
ঘটনা সামনে আসতে দেশ জুড়ে হইচই শুরু হয়। কিন্তু তৎকালীন মেহবুবা মুফতি সরকারের মন্ত্রী লাল সিংহ-সহ কয়েক জন বিজেপি নেতা ও জম্মুর হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠন অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়ান। তাঁরা দাবি করেন, বকরওয়াল সম্প্রদায়ই বিভাজনের রাজনীতি করছে। অভিযুক্তদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। কাঠুয়ার আদালতে চার্জশিট পেশ করতেও বাধা দেন স্থানীয় আইনজীবীদের একাংশ। ২০১৮ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলা পঞ্জাবের পঠানকোটে সরানো হয়।
কোন পথে মামলা
• ১০ জানুয়ারি, ২০১৮: কাঠুয়া জেলার রসানা গ্রাম থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় বকরওয়াল সম্প্রদায়ের আট বছরের বালিকা।
• ১২ জানুয়ারি, ২০১৮: হিরানগর থানায় এফআইআর করেন নিখোঁজ বালিকার বাবা।
• ১৭ জানুয়ারি, ২০১৮: উদ্ধার বালিকার ক্ষতবিক্ষত দেহ। ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, গণধর্ষণের পরে খুন করা হয় তাকে।
• ২২ জানুয়ারি, ২০১৮: জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের অপরাধ দমন শাখার হাতে তুলে দেওয়া হয় মামলার দায়িত্ব।
• ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮: অভিযুক্তদের সমর্থনে বিক্ষোভ দেখায় ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’ নামে একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন।
• ১ মার্চ, ২০১৮: দেবীস্থান মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক সাঞ্জী রাম, তার ছেলে বিশাল জনগোত্রা, সাঞ্জী রামের নাবালক ভাইপো, তার বন্ধু পরভেশ কুমার এবং চার পুলিশকর্মী গ্রেফতার।
• ৯ এপ্রিল, ২০১৮: আট অভিযুক্তের মধ্যে সাত জনের বিরুদ্ধে কাঠুয়া আদালতে চার্জশিট দায়ের করে পুলিশ। নাবালকের বয়স নির্ধারণ করা হচ্ছে।
• ১৪ এপ্রিল, ২০১৮: রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’-এর আন্দোলনে যোগ দেওয়া বিজেপি মন্ত্রীরা।
• ১৬ এপ্রিল, ২০১৮: কাঠুয়ার মুখ্য দায়রা আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু।
• ৭ মে, ২০১৮: কাঠুয়া থেকে মামলাটি পঞ্জাবের পঠানকোটে সরায় সুপ্রিম কোর্ট। ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে রোজ ‘ইন ক্যামেরা’ শুনানির নির্দেশ।
• ৩ জুন, ২০১৯: বিচার প্রক্রিয়া শেষ।
আজ পঠানকোটে দায়রা আদালতের বিচারক জম্মু-কাশ্মীরে প্রচলিত রণবীর দণ্ডবিধি মেনে সাঞ্জী রাম, দীপক খাজুরিয়া, পরভেশ কুমারকে গণধর্ষণ, খুন, ষড়যন্ত্র-সহ সাতটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সন্দেহের অবকাশ থাকায় মুক্তি পেয়েছে সাঞ্জী রামের ছেলে বিশাল জনগোত্র। প্রমাণ লোপের অভিযোগে সাব-ইনস্পেক্টর আনন্দ দত্ত, হেড কনস্টেবল তিলক রাজ ও স্পেশ্যাল পুলিশ অফিসার সুরেন্দ্র বর্মার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। এই তিন জনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। জরিমানা না দিলে তাদের আরও ছ’মাস জেল খাটতে হবে। রামের ভাইপো নাবালক কি না, তা নিয়ে জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টে শুনানি চলছে। সরকার পক্ষ মৃত্যুদণ্ডের আর্জি জানিয়েছিল।
যাযাবর বকরওয়াল সম্প্রদায়ের পেশা পশুপালন। তাই উপত্যকা ও জম্মুর মধ্যে যাতায়াত করতে হয় ওই সম্প্রদায়ের মানুষকে। আজ রায়ের সময়ে পঠানকোটের আদালতে হাজির থাকতে পারেননি ওই বালিকার বাবা-মা। তখন ভেড়া আর গবাদি পশু নিয়ে তাঁরা কাশ্মীরের পথে। নিজেদের দুই মেয়ে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরে ওই বালিকাকে দত্তক নিয়েছিলেন এই দম্পতি। পথেই তাঁদের আইনজীবী ফোনে রায়ের কথা জানান। বাবা-মা দু’জনেই ফোনে এক বাক্যে বললেন, ‘‘আমরা সন্তুষ্ট নই। ওরা যা করেছে তাতে মৃত্যুদণ্ডও যথেষ্ট নয়।’’
সরকারি আইনজীবী এস এস বসরা পঠানকোট থেকে ফোনে বলেন, ‘‘এই মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী নেই। কিন্তু পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ যথেষ্ট জোরালো। কিন্তু তা সত্ত্বেও অপরাধীদের কড়া শাস্তি হয়নি। সন্দেহের অবকাশ রয়েছে মনে করে বিচারক এক জনকে মুক্তিও দিয়েছেন। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।’’ প্রায় একই সুরে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতি।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।