রিয়েল কাশ্মীর-মোহনবাগান ম্যাচ চলাকালীন গ্যালারি। ছবি: পিটিআই
ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসিনি। তবু ভাবছিলাম, ‘কাশ্মীরের রং আজ সবুজ-মেরুন’ দিয়ে শুরু করলে কেমন হয়?
ঘরের টিমকে ছেড়ে অ্যাওয়ে টিমের হয়ে গলা ফাটাচ্ছে গ্যালারির নানা অংশ। আজ পাঁচ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের শ্রীনগরে মোহনবাগান বনাম রিয়েল কাশ্মীর আই লিগের খেলা দেখতে নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে হাজার-হাজার লোক আসেনি।
এই সমর্থকেরা কাশ্মীরিই। গোটা ম্যাচের সময়টায় যাঁরা ‘মোহন-বাগান.. মোহন-বাগান’ বলে সমানে চেঁচিয়ে গেলেন। এবং রিয়েল কাশ্মীর ০-২ গোলে ম্যাচ হেরে যাওয়া সত্ত্বেও আনন্দবাজারকে যাঁরা খোলাখুলি বলে গেলেন, মোহনবাগান ‘পশ্চিমবঙ্গের টিম’ এবং ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যের টিম’ বলেই আজ তাদের দিলখোলা সমর্থন দিয়েছেন। কারণ, কাশ্মীরে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ছাত্রসমাজ। এখনও মমতা ‘মানুষের জন্য’ লড়ছেন। অর্থাৎ সিএএ, এনআরসি এবং এনপিআরের বিরুদ্ধে তৃণমূল নেত্রীর প্রতিবাদের কথাই বোঝালেন তাঁরা।
দিনটাও যেন বহু দিনের জমা আবেগ বেরিয়ে আসার পক্ষে উপযুক্ত। গত বছরের অগস্টে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার পরে টানা নিষেধাজ্ঞা, গ্রেফতারি, ঘরবন্দি হয়ে থাকা, মোবাইল-নেট বন্ধ— এ সবের পরে আজই সেই অর্থে আম আদমির জন্য প্রথম কোনও বড়সড় বিনোদনের আয়োজন উপত্যকায়। হাড়কাঁপানো ঠান্ডাতেও তাই খোলা
হাওয়ায় ফুসফুস ভরে নেওয়ার সুযোগ। সকাল ১১টায় আই লিগের ম্যাচ শুরু। কিন্তু ভিড় জমছিল ৯টা থেকেই। কাশ্মীরের নানা প্রান্ত থেকে দর্শকেরা এসেছিলেন আজ। এমনকি জঙ্গি-সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগে চলা দক্ষিণ কাশ্মীর থেকেও।
তিন দফা তল্লাশি পেরিয়ে মিলেছে স্টেডিয়ামে ঢোকার ছাড়পত্র। স্টেডিয়ামও যেন দুর্গ। প্রত্যেকটা গেটে পুলিশ-আধাসেনার পাহারা, সাঁজোয়া গাড়ি। তৈরি ছিল ড্রোনও। বাইরে ছিলেন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা। জানা গেল, হাজার দশেক লোক এসেছিলেন মাঠে। তা-ও যোগাযাগ ব্যবস্থা বেহাল, না-হলে ভিড় বাড়ত বলেই মনে হয়।
আর গ্যালারিতে সেই ভিড়েরই একটা বড় অংশ স্লোগান দিল কলকাতার গঙ্গাপারের ক্লাবের নামে। সত্যি বলতে কি, আজ মোহনবাগানের নাম ধরে যত চিৎকার শুনলাম, রিয়েল কাশ্মীরের নামেও তত শুনিনি!
বদগাম থেকে আসা আহমেদ আয়াজ় ম্যাচের পরে বলছিলেন, ‘‘বাংলার মানুষ মুসলিমদের পাশে আছেন। মুসলিমদের জীবন নরক করে দেওয়া হয়েছে সারা দেশে। তাই আজ প্রাণ ঢেলে মোহনবাগানকে সমর্থন করেছি।’’ শোপিয়ানের শওকত শরাফ মনে করেন, শুধু মুসলিমেরা নন, সারা দেশের মানুষেরই একটা শক্ত ভরসা দরকার। তাঁর কথায়, ‘‘একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের জন্য যুদ্ধ করছেন। মোহনবাগান তো তাঁরই রাজ্যের ক্লাব।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহম্মদ টাকি অবশ্য মনে করেন, উত্তরপ্রদেশের মতো যেখানেই এখন মানুষের উপরে ‘নিপীড়ন’ হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মতো অনেকেই তার প্রতিবাদ করছেন। একই ভাবে উপত্যকায় গত পাঁচ মাসের কড়াকড়ির প্রতিবাদে যাঁরা সরব হয়েছেন, কাশ্মীরিরাও তাঁদের ভুলবেন না। এখানেই বাংলার জন্য বিশেষ বার্তা দিচ্ছেন মহম্মদ। বলছেন, ‘‘কাশ্মীরের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, সাংসদেরা, বিশিষ্ট জনেরা, ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ করেছেন। বাংলায় যেন এই বার্তা যায় যে, কাশ্মীরিরাও তাঁদের পাশে আছেন।’’
পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়ামন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা অরূপ বিশ্বাস বললেন, ‘‘এক সময়ে গোখেল বলেছিলেন,‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো।’ এখন ‘হোয়াট মমতা থিঙ্কস টুডে, রেস্ট অব ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো’। সিএএ, এনআরসি, এনপিআরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মমতা সারা দেশকে পথ দেখিয়েছেন। সকলেই এখন সেই প্রতিবাদের পথে আসছেন।’’ রাজনৈতিক মহলেরও অনেকে মানছেন, বাংলার প্রতিনিধি হিসেবেই কাশ্মীরের সমর্থন পেয়েছে মোহনবাগান। আর কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের জন্য কাশ্মীরিদের সমর্থনকে সামগ্রিক প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই দেখা যেতে পারে।
সহ প্রতিবেদন: সন্দীপন চক্রবর্তী