কমল নাথ। ছবি: পিটিআই।
প্রতীক্ষার শেষ। এখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মিনিট গুনছেন ছিন্দওয়াড়ার মানুষ।
ঘরের ছেলে কমল নাথকে যে ভাবে ক্ষমতায় বসার পনেরো মাসের মাথায় সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা ভাল ভাবে নেয়নি ছিন্দওয়াড়া। দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করেছে সাড়ে তিন বছর।
শুক্রবার সেই দিন। মধ্যপ্রদেশের ভোট। যাবতীয় বঞ্চনার জবাব ভোটে মিটিয়ে দেওয়ার পণ করেছে কমল নাথের দ্বিতীয় ভিটে বলে পরিচিত ছিন্দওয়াড়া। আর বিজেপি যেখানে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখতে একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-সাংসদদের মাঠে নামিয়েছে, সেখানে একা হাতে কংগ্রেসকে রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কমল নাথ।
কেবল ছিন্দওয়াড়াই নয়, সাড়ে তিন বছর আগে যে ভাবে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ও তাঁর অনুগামী দল বদল করে সরকার বদলে দিয়েছিলেন, সেই বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি ইন্দোর, চম্বল, ভোপাল— সর্বত্র তুলে ধরেছেন কংগ্রেস কর্মীরা। উদ্দেশ্য, প্রতিশোধের আগুনকে খুঁচিয়ে তুলে বিজেপির বিরুদ্ধে আমজনতার ভোট নিশ্চিত করা। পথেঘাটে, দোকানে, চায়ের আড্ডায়, বাসের সফরে, সব জায়গাতেই আলোচনায় একটি বিষয় উঠে এসেছে—তা হল, যে ভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল বিজেপি, তা অন্যায় হয়েছিল।
সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই ভুলের জন্য খেসারত দিতে হতে পারে তা ঘরোয়া ভাবে মেনে নিচ্ছেন বিজেপি কর্মীরাও। তাঁরাও মনে করছেন, বহু মানুষ বিজেপির ওই কাজের জন্য কংগ্রেসের জয় চাইছেন। কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি, পরিস্থিতি যা তাতে ম্যাজিক সংখ্যার থেকে অনেক বেশি পাবে দল। কমল নাথ গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে যে রণনীতি তৈরি করে ময়দানে নেমেছেন, তাতে পাত্তা পাবে না বিজেপি। নিয়োগ-দুর্নীতি, বেহাল অর্থনীতি, কৃষকদের ফসলের দাম না পাওয়ার সমস্যা, বীজধান ও সারের বর্ধিত দাম, মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতা, আদানি-মোদী সম্পর্কের মতো বিষয়গুলি নিয়ে প্রচারের ঝড় তুলেছে কংগ্রেস। অন্য দিকে লাডলি বহেন প্রকল্পে মহিলাদের তিন হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, শিল্প পরিকাঠামো উন্নত করা, জেলায় জেলায় সরকারি হাসপাতাল, বিনা মূল্যে একশো ইউনিট বিদ্যুৎ দেওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি সামনে রেখে দুর্গ সামলাতে মরিয়া বিজেপি নেতৃত্ব।
আগামী শনিবার ৭৭ বছরে পা দিচ্ছেন কমল নাথ। এটাই যে তাঁর সামনে শেষ সুযোগ তা বিলক্ষণ জানেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্সের স্নাতক। সেই কারণে গোড়া থেকেই একবগ্গা কমল নাথ গোটা মধ্যপ্রদেশ জুড়ে জাতপাতের ভিত্তিতে ছক কষে প্রার্থী দিয়েছেন। কাউকে নাক গলাতে দেননি।
এই নীরব প্রস্তুতি অবশ্য শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে সিংহাসন হারানোর পর থেকেই। বিজেপি নেতা অমিত শাহ কমল নাথ ও দিগ্বিজয় সিংহের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে প্রচার করলেও কংগ্রেস সূত্রের মতে, কমল নাথ গোড়াতেই স্পষ্ট ভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দেন, মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে অন্য কারও হস্তক্ষেপ তাঁর পছন্দ নয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে নিজেই সরে যান দিগ্বিজয়। কমল নাথকে কার্যত পূর্ণ স্বাধীনতা দেন কংগ্রেস কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনকি, ‘ইন্ডিয়া’ ভোপালে জনসভা করার পরিকল্পনা নিলেও তা বাতিল হয়ে যায় কমল নাথের কারণে। সে সময়ে সনাতন ধর্ম নিয়ে ‘ইন্ডিয়া’র শরিক ডিএমকে নেতৃত্ব বিতর্কিত মন্তব্য করায় ওই জনসভা বাতিল করে দেন কমলনাথ। রাজনৈতিক শিবিরের ব্যাখ্যা, সে সময়ে ওই জনসভা হলে সনাতন বিতর্ককে সামনে রেখে হিন্দু ভোটের মেরুকরণে নেমে পড়ত বিজেপি। পাশাপাশি বিজেপিকে রুখতে ধারাবাহিক ভাবে মন্দিরে মন্দিরে পুজো-পাঠ, ধর্মীয় করিডর তৈরির প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি নিজেকে হনুমানের ভক্ত হিসাবে প্রচার করে নরম হিন্দুত্বের বার্তা নিয়মিত দিয়েছেন কমল নাথ। যাতে হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে না যায়।
ভোপাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা শিবরাজ সিংহের কেন্দ্র বুধনি পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় ছিন্দওয়াড়ায়। ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল ছিন্দওয়াড়া। পরবর্তী সময়ে ছিন্দওয়াড়া লোকসভা থেকে ৯ বার জিতে আসা কমল নাথের উদ্যোগে কার্যত ভোল পাল্টে যায় গোটা এলাকার। ছিন্দওয়াড়ার শিকারপুরে কমল নাথের বাড়ির পাশেই রয়েছে হেলিপ্যাডও। ভোপাল বা নাগপুর থেকে ছিন্দওয়াড়া গেলে হেলিকপ্টারেই যাতায়াত পছন্দ করেন কমল নাথ। মাঠের পাশেই শিকারপুর উচ্চ বিদ্যালয়।
চায়ের দোকানে আলাপ হল ওই স্কুলের শিক্ষক বৈজুপ্রসাদ মিশ্রের সঙ্গে। বললেন, ‘‘এলাকায় কমল নাথের এতটাই প্রভাব যে বিজেপি প্রার্থী বিবেক বান্টু সিংহ কত ভোটে হারবেন, তা নিয়ে বাজি লাগানো শুরু হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় মানুষ ঘরের ছেলেকে ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান। গত বার যা হয়েছিল তা ‘ইনসাফ’ নয়। বিশ্বাসঘাতকতা।’’
তবে গত বার ওই আসন থেকে বিজেপি প্রার্থী ৪৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। ২০১৩ সালে বিজেপি ওই কেন্দ্রে জিতেছিল। ফলে এলাকায় বিজেপির ভোট যে রয়েছে তা মেনে নিচ্ছেন স্থানীয় কংগ্রেস দফতরে উপস্থিত রাজেশ সূর্যবংশী। যদিও তাঁর কথায়, ‘‘গত দু’বার কমলনাথ এখান থেকে লড়েননি। আর এ বার তো স্পষ্ট, জিতলে উনি মুখ্যমন্ত্রী হবেন। তাই ঘরের ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে ওই (বিজেপির পক্ষে যা রয়েছে) ভোটও কমল নাথ পাবেন বলে বিশ্বাস।’’
জনশ্রুতি, এক সময়ে প্রচুর সিংহের বাস ছিল এই এলাকায়। সিংহের ঘাঁটি হওয়ায় ওই এলাকাটিকে ‘সিং দ্বার’ বলা হত। অনেকের মতে, সেই শব্দটি থেকেই অপভ্রংশ হয়ে ছিন্দওয়াড়া শব্দটি এসেছে।
আর এ বার লোকে বলছে, এখন ছিন্দওয়াড়ার আহত সিংহের নাম কমল নাথ।