জয়ের পর সাংবাদিক বৈঠকে হেমন্ত সোরেন। ছবি: পিটিআই।
ঝাড়খণ্ডের পাঁচ দফার ভোটে মোট ন’বার প্রচারে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাজ্য জুড়ে তাঁর বিশাল কাটআউট, ফ্লেক্স। রাঁচীতে বসে বিজেপি নেতারা দাবি করেছিলেন, মোদী-ম্যাজিকে ভর করেই ফের ক্ষমতায় আসবেন তাঁরা। যেমনটা হয়েছে কয়েক মাস আগের লোকসভা নির্বাচনে। ১৪টি লোকসভা আসনের ১১টিতেই জিতেছে বিজেপি। একটিতে তৎকালীন জোটসঙ্গী আজসু। বিজেপি নেতারা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘‘আব কি বার, ৬৫ পার।’’
সোমবার ফলপ্রকাশের পরে দেখা গেল, ৮১ আসনের মধ্যে বিজেপির ঝুলিতে এসেছে ২৫টি। গত বারের থেকে ১২টি কম। বিজেপি ছেড়ে নির্দল হিসেবে দাঁড়ানো স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা সরযূ রাইয়ের কাছে হেরেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস। অন্য দিকে, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম)-র জোট পেয়েছে ৪৭টি আসন। তার মধ্যে হেমন্ত সোরেনের দল একাই ৩০টি। কংগ্রেসের আসন ১৬, আরজেডির ১।
এ দিন ভোটের হাওয়া স্পষ্ট হওয়ার পরে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে হার স্বীকার করে নেন রঘুবর। বলেন, ‘‘এটা আমার হার, বিজেপির নয়।’’ কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে আড়াল করার চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন। তাঁরা মনে করাচ্ছেন, রাজ্য জুড়ে রঘুবরের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে বুঝতে পেরে ভোটের সব দায়দায়িত্বই কার্যত নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। মোদীর মতোই রাজ্যে ৯ বার প্রচারে এসেছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ।
দু’জনেই প্রচার করেছেন কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ, রামমন্দির নির্মাণ, তিন তালাক রদ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) চালু করার সাফল্য-গাথা। কিন্তু ভোটের ফল বলছে, সেই প্রচারকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে হেমন্তের ‘জল-জঙ্গল-জমি’-র অধিকারের লড়াই। আদিবাসী-ওবিসি-সহ অন্যেরাও ভোট দিয়েছেন নিজের অপ্রাপ্তির হিসেব কষেই। তাই রাজ্যের ২৬ শতাংশ আদিবাসী ভোট ছাপিয়ে জেএমএম জোটের প্রাপ্ত ভোট প্রায় ৩৭ শতাংশ। বিজেপির একটি সূত্র রাতে জানিয়েছে, মোদী-শাহ যে-সব জায়গায় জনসভা করেছিলেন, তার বেশির ভাগ এলাকাতেই দল হেরেছে।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধেও ঝাড়খণ্ডবাসী ভোট দিয়েছেন বলে অভিমত পর্যবেক্ষকদের। এই বিল পাশ হওয়ার পরে দু’দফায় ১৮টি আসনে ভোট হয়েছিল রাজ্যে। রাত পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে এর মধ্যে ১২টিতেই ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির। উল্টো দিকে সাঁওতাল পরগনায় প্রচারে গিয়ে হেমন্ত স্পষ্ট বলে এসেছিলেন, জেএমএম জিতলে ঝাড়খণ্ডে সিএএ বা এনআরসি কিছুই হবে না।
আরও পড়ুন: সত্য ফাঁস! এনআরসি হবে, মোদী তো বলেছিলেন এপ্রিলেই
এ দিনই হেমন্ত সোরেনকে অভিনন্দন জানিয়ে করা টুইটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সিএএ-এনআরসি নিয়ে প্রতিবাদের মধ্যেই এই ভোট হয়েছে। এই রায় নাগরিকদের পক্ষে।’ জবাবে হেমন্ত বলেন, ‘এটা ছিল গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা এবং সামাজিক ভাবে সকলকে নিয়ে চলার লড়াই।’ টুইটে জেএমএম জোটকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও। পাশাপাশি, ‘অনেক বছর ধরে বিজেপিকে সেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য’ ঝাড়খণ্ডবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।
বিজেপির পক্ষে ভোট দরিয়া পার হওয়া যে কঠিন, তা অবশ্য বোঝা গিয়েছিল প্রচার পর্বেই। বেশ কয়েকটি সভায় লোক তেমন না-হওয়ায় প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন অমিত শাহ। পরিস্থিতি বিজেপির হাতের বাইরে চলে যাওয়ার একটা বড় কারণ আদিবাসী ভোট বিমুখ হওয়া। আদিবাসীদের জন্য তৈরি রাজ্যে পাঁচ বছর আগে ওবিসি নেতা রঘুবর দাসকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে ঝাড়খণ্ডে ‘হরিয়ানার খট্টর মডেল’ চালু করে বাজিমাৎ করতে চেয়েছিল বিজেপি।
আরও পড়ুন: ‘প্রধানমন্ত্রী, ডিটেনশন ক্যাম্প নেই? ছেলেটা তবে মরল কোথায়?’
কিন্তু গত পাঁচ বছরে আদিবাসীদের অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার জন্য সবাই দায়ী করেছেন রঘুবর-সরকারের নীতিকেই। আদিবাসীদের ক্ষোভের আগুনে আরও ঘি ঢেলেছে জমি-নীতি। আদিবাসীদের জমি বৃহৎ পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেননি বিজেপির একাংশও। বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে ভোটে লড়েছে কুর্মি সম্প্রদায়ের দল অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আজসু)।
রঘুবরকে ‘আদিবাসী বিরোধী’ বলে দেগে দিয়েছেন বিরোধীরাও। ভোটের আগে রঘুবরের একটি ভিডিয়ো ‘ভাইরাল’ হয়। সেই ভিডিয়োয় মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘হাম আদিবাসী-মুক্ত ঝাড়খণ্ড বনায়েঙ্গে।’ পরে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেন, তিনি আসলে ‘প্লাস্টিক-মুক্ত ঝাড়খণ্ড’ বানানোর কথা বলতে চেয়েছিলেন। আদিবাসী কথাটি হঠাৎ-ই বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতেও আদিবাসীদের ক্ষোভকে কমানো যায়নি।
এই অবস্থায় বিজেপির শেষ ভরসা ছিল দু’টি। আদিবাসী এলাকায় আরএসএস-এর সংগঠন এবং তাদের জনসেবামূলক প্রকল্প। আর মোদী-ম্যাজিক। কিন্তু কাজে আসেনি কিছুই। সোমবার রাঁচির বিজেপি নেতারা বলেন, এতটা খারাপ ফল তাঁরা আশা করেননি। তবে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু উল্টো দিকে সবাই এক জোট হওয়ায় সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেছে।
গত বারের বিধানসভা ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ৩৭টি আসন। পরে বাবুলাল মরান্ডির জেভিএম-এর ছ’জন বিধায়ককে দলে টেনে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৩। সঙ্গে জোটসঙ্গী আজসু-র ৫। এ বার তারা প্রায় অর্ধেক।