যে কোনও বড় বদলে যিনি পথ দেখান, তাঁকে আমরা সেই বিষয় বা পরিবর্তনের সঙ্গে জুড়ে দিই। শিব নাদার সেই হিসেবে ভারতের ‘আইটি ম্যান’।
অতিমারি পরিস্থিতিতে এখন ল্যাপটপেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দুনিয়া। শিব সেই ল্যাপট্যাপের প্রথম ধাপ ‘পার্সোনাল কম্পিউটার’ বা পিসির সঙ্গে ভারতের আমজনতাকে পরিচয় করিয়েছিলেন। তাঁর সংস্থা হিন্দুস্তান কম্পিউটারস লিমিটেড বা এইসিএল এখন বিশ্বের আইটি সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম। ফোর্বসের তালিকাতেও এইচসিএলের নাম আছে।
শিব নিজেও ভারতের তৃতীয় ধনী ব্যক্তি। প্রভাবশালীও। বছর কয়েক আগে এক জাতীয় স্তরের সংবাদ সংস্থার বিচারে ভারতের প্রথম ৫০ জন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির তালিকায় ১৬ নম্বরে নাম ছিল শিবের। তারও আগে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শিবকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করেছিল কেন্দ্র। শিব এখন দু’হাজার ৯৩০ কোটি মার্কিন ডলারের সম্পত্তির মালিক। এই বিপুল সম্পদের পুরোটাই শিবের নিজের পরিশ্রমের ফসল।
শিব শুরু করেছিলেন মাত্র ১৮ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে। ১৯৭৬ সালে এইচসিএলের মূল সংস্থা প্রতিষ্ঠার সময়ে ওই ক’টা টাকাই ছিল শিবের মূলধন। যদিও স্বপ্ন ছিল অনেকটাই বড়।
রাজনৈতিক নানা কারণে তখন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে তথ্য ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত সংস্থা আইবিএম। শিব সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগান।
ভারতে তখন কম্পিউটার বলতে আইবিএম। নাম আইবিএম ১৪০১। তবে সেই কম্পিউটারের রক্ষণাবেক্ষণ অনেক জটিল। ২৪ ঘণ্টা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ডেটা স্টোরেজের জন্য দরকার পড়ত আলাদা ঘরের। প্রযুক্তির দিক থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকা ‘১৪০১’-এ কাজও হত অত্যন্ত ধীর গতিতে। তবু এই কম্পিউটারই লিজ দিয়ে প্রতি কম্পিউটারে বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা করে আয় করত আইবিএম।
শিব দেশে প্রথম এমন কম্পিউটার নিয়ে এলেন যা তিন লক্ষ টাকায় পুরোপুরি কিনে নেওয়া যাবে। ডেটা স্টোরেজের জন্য আলাদা ঘরের দরকার নেই। ব্যক্তিগত পরিসরে ব্যবহারের উপযোগী ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা পিসি।
১৯৭৮ সালে ভারতকে প্রথম পার্সোনাল কম্পিউটার দিয়েছিল এইচসিএল-ই। অ্যাপেল কিংবা আইবিএম নয়। এমন কম্পিউটার যা মাঝারি মানের সংস্থাগুলির তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত চাহিদা মেটাতে পারবে। নাম দেওয়া হয় এইচসিএল ৮সি।
তত দিনে অবশ্য শিবের ব্যবসায়িক ভাবনা এবং মননে উৎসাহিত উত্তরপ্রদেশের সরকার এইচসিএলে বিনিয়োগ করেছে। পরিবর্তে উত্তরপ্রদেশ সরকারের নামে এইচসিএলের ২৬ শতাংশ শেয়ার লিখে দিয়েছেন শিব। সরকারের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার অংশীদারিত্ব সে সময়ে খুব একটা প্রচলিত বিষয় ছিল না। সে দিক থেকে দেশে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-র অন্যতম প্রথম নিদর্শনও এইচসিএল।
উত্তরপ্রদেশ সরকার অবশ্য বিনিয়োগের শর্ত হিসেবে এইচসিএলের নাম বদলাতে চেয়েছিল। এইচসিএলের বদলে ইউপিসিএল নাম রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয় শিবকে। শিব রাজি হননি। তাঁর সংস্থার নাম হিন্দুস্তান কম্পিউটারস লিমিটেডই রেখেছিলেন। যুক্তি ছিল, এতে সংস্থাটির একটি সর্বভারতীয় আবেদন থাকবে।
এর পর এইচসিএলের ব্যবসা ক্রমে বেড়েছে। দেশ থেকে বিদেশে। ১৯৯০ সালে গোটা বিশ্বেই কম্পিউটার প্রযুক্তি সংস্থা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ভারতের এই সংস্থা। ২০২১ সালের হিসেব বলছে ৫০টি দেশে এখন ১ লক্ষ ৬৯ হাজার কর্মী রয়েছে সংস্থাটির। এইচসিএলের বর্তমান আয় বছরে ৭৬ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা।
অথচ শিব কোনও ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন না। ১৯৪৫ সালে তামিলনাড়ুর একটি প্রত্যন্ত গ্রাম মুলাইপোজিতে জন্ম তাঁর। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। পড়াশোনা করেছেন মাদুরাই, ত্রিচি, কোয়ম্বত্তুরের স্কুল-কলেজে। ইলেকট্রিকাল এবং ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শিব ২২ বছর বয়সে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থাতেই নিজের চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন।
তার পর আট বছরে তিন বার চাকরি বদলের পর শিবের উপলব্ধি হয়, দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টার পরিশ্রম কোনও কাজে লাগছে না। যদি এই সময় দিতেই হয় তবে নিজের ভাল লাগার ক্ষেত্রেই ব্যয় করবেন। ক্যালকুলেটর বিভাগে কাজ করতেন শিব। সেখানেই সমমনস্ক কয়েক জনকে নিয়ে নতুন সংস্থা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে তৈরি করেন নিজেদের সংস্থা মাইক্রোকম্প লিমিটেড। শিবের সঙ্গে ছিলেন অজয় চৌধুরি। যিনি পরবর্তীকালে এইচসিএলের চেয়ারম্যান হন। ছিলেন বর্তমানে হেডস্ট্রং সংস্থার সিইও এবং চেয়ারম্যান অর্জুন মলহোত্রও। এঁরা ছাড়াও আরও বেশ কয়েক জন সহকর্মী মিলে শুরু করেন মাইক্রোকম্প। সংস্থাটি টেলিডিজিটাল ক্যালকুলেটর বিক্রি করত। সেটা ১৯৭৫ সাল।
পরের বছরই আইবিএমের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে নতুন সুযোগ সামনে আসে শিবের। ব্যবসায়ী শিব সুযোগ চিনে নিতে দেরি করেননি।
দীর্ঘ ৪৫ বছরে এইচসিএল অনেক বদলেছে। সংস্থাটি কম্পিউটার প্রযুক্তি থেকে অনেকটাই এগিয়ে বিস্তারিত হয়েছে উড়ানশিল্প, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য, রাসায়নিক, খনিজ সম্পদ, তেল, গ্যাস, টেলিযোগাযোগ, পর্যটন, শেয়ার বাজার, বিমা এমনকি বিনোদন জগতেও।
তবে শিল্পে সাম্রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিও কর্তব্য করেছেন শিব। সামাজিক বিভিন্ন কাজ, শিক্ষা ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এ পর্যন্ত ১০০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছেন তিনি।
ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, শিবকে তাঁর কাছের বন্ধুরা ডাকে ‘ম্যাগাস’ বলে। ম্যাগাস অর্থাৎ জাদুকর। তবে শিব যে ভাবে ভারতীয় সংস্থা এইচসিএলকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন, তাতে তাঁকে পরশপাথর বললেনও অত্যুক্তি হয় না।