অনেক ক্ষেত্রেই রুপোলি পর্দার মাত্রাছাড়া হিংসা দুর্বৃত্তদের দুষ্কর্মে ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে আক্ষেপ করেন অনেকে। এখন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, হিংসা-নাশকতার মাত্রা কী ভাবে তীব্রতর করা যায়, হিন্দি ছবির কাছে তার পাঠ নিচ্ছে পড়শি দেশের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-ও।
বলিউডের ছবি পাকিস্তানে বরাবরই জনপ্রিয়। পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই মুম্বইজাত কোনও কোনও ছবি থেকে প্ররোচনার রসদ খুঁজে নিচ্ছে বলে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র গোয়েন্দাদের একাংশের সন্দেহ। বিশেষ করে ৩৫ বছর আগেকার একটি ছবি কি আইএসআই-কে ভারতে নাশকতা ঘটানোর নয়া ছক তৈরিতে প্ররোচিত করছে, এই প্রশ্নটি তাঁদের ভাবাচ্ছে। পুরী, খড়্গপুর, ভুবনেশ্বর-সহ বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনে পরপর অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে প্রাথমিক খোঁজ নিয়ে এমন সন্দেহ দানা বাঁধছে তাঁদের মনে।
সেই ছবির নাম ‘দ্য বার্নিং ট্রেন’। রবি চোপড়ার ওই ছবিতে নয়াদিল্লি-মুম্বই রুটে দ্রুতগামী ‘সুপার এক্সপ্রেস’ তার উদ্বোধনী যাত্রাতেই মথুরা স্টেশন ছাড়ার পরে আগুনের কবলে পড়ে। ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে এক ব্যক্তি ট্রেনে বোমা রেখে এমন ভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, যাতে ব্রেকও অকেজো হয়ে যায়। যাত্রী-ভর্তি ট্রেন পরিণত হয় দুরন্ত গতিতে ছুটতে থাকা এক অগ্নিকুণ্ডে।
‘‘সিনেমার মতো ব্যাপারটা হয়তো অত নাটকীয় হবে না। কিন্তু বাস্তবে আইএসআই যে-ছক কষেছে বলে আমরা টের পাচ্ছি, সেটা ভয়ঙ্কর। চলন্ত ট্রেনে একসঙ্গে একাধিক কামরায় আগুন লাগানো হবে, যাতে আতঙ্কেই কিছু যাত্রী মারা পড়েন,’’ বললেন এনআইএ-র এক অফিসার। তাঁর বক্তব্য, চক্রীরা যাত্রাপথের এমন জায়গায় ট্রেনে আগুন ধরানোর মতলবে আছে, যার কাছাকাছি স্টেশন নেই। অর্থাৎ ট্রেনের যখন সব চেয়ে বেশি গতিতে ছোটার কথা।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মতে, সাধারণ ভাবে নাশকতা
বলতে বোঝায় জনবহুল এলাকা বা ভিড়ে ঠাসা যানবাহনে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বা বুলেট-হামলা চালিয়ে অথবা যন্ত্র কিংবা যাত্রাপথের যন্ত্রাংশ বা সরঞ্জাম বিগড়ে দিয়ে বস্তু-সম্পত্তি বা মানবসম্পদ নষ্ট করা। চলন্ত ট্রেনে আইএসআইয়ের আগুন লাগানোর এই ষড়যন্ত্র নাশকতার ধারণায় অন্য রকম মাত্রা যোগ করতে পারে। কলকাতা, মেরঠ, কাশ্মীরে যখন একের পর এক আইএসআইয়ের সন্দেহভাজন এজেন্টরা ধরা পড়ছে, তখন পাক গুপ্তচর সংস্থার নয়া নাশকতার পরিকল্পনায় উদ্বিগ্ন কেন্দ্র।
ইনটেলিজেন্স ব্যুরো-র এক অফিসারের বক্তব্য, নাশকতার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই এটা ভাবা হয় যে, এমন ভাবে কাজটা করতে হবে যেটা প্রতিরোধের জন্য কেউ তৈরি নয়। ভাবাই যায়নি, এমন কিছু ঘটতে পারে। ‘‘ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি বিস্ফোরণ বা গুলি চালিয়ে হামলার পরিচিত ছক ছেড়ে সেই জন্যই হয়তো ট্রেনে আগুন লাগানোর চক্রান্ত করা হয়েছে,’’ বললেন ওই অফিসার।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন ট্রেনের অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে গত বছরের ১ মে চেন্নাই স্টেশনে একটি ট্রেনে বিস্ফোরণের যোগসূত্র মিলেছে। সে-বার বেঙ্গালুরু-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের দু’টি কামরায় দু’টি বোমা বিস্ফোরণে এক মহিলা নিহত এবং ১৪ জন আহত হন। আইবি-র এক অফিসার বলেন, ‘‘ওটাই মনে হচ্ছে ট্রেনে নাশকতার শুরু। তবে সে-বার দু’টি বিস্ফোরণ ঘটালেও ক্ষয়ক্ষতি তুলনায় কমই হয়েছিল। তাই হয়তো এ বার অগ্নিসংযোগের ছক কষা হয়েছে।’’
পুরী স্টেশনে গত ১২ নভেম্বর বিকেলে তিনটি এক্সপ্রেস ট্রেনের মোট পাঁচটি কামরা আগুনে পুড়ে যায়। ওই দিনই দুপুরে ভুবনেশ্বর স্টেশনে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির একটি স্লিপার কোচে আগুন লাগে। ওই বগিতে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী ছিলেন। তবে আগুন লাগার ব্যাপারাটা দ্রুত ট্রেনচালকের নজরে পড়ে যাওয়ায় কারও ক্ষতি হয়নি। সে-দিন সকালে খড়্গপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রেনের বগিতে আগুন লাগে। আবার ৪ নভেম্বর হরিদ্বার স্টেশনে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কামরায় আগুন লেগেছিল। অন্ধ্রপ্রদেশের পার্বতীপুরম স্টেশনের কাছে কয়লা বোঝাই মালগাড়িতে আগুন লাগে ১ নভেম্বর।
অর্থাৎ সাতটি ট্রেনে অগ্নিকাণ্ড শুধু নভেম্বরেই। তবে কোথাও হতাহতের খবর নেই। ওই সব অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে একটি মামলা রুজু করে শীঘ্রই তদন্ত শুরু করবে এনআইএ। ওই সাতটি ট্রেনে আগুনের উৎস কী, সেটা খুঁজে বার করাই অগ্রাধিকার পাবে সেই তদন্তে। প্রাথমিক খোঁজখবর নিয়ে এনআইএ-র মনে হয়েছে, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড একই পরিকল্পনার অঙ্গ। বড় ঘটনা ঘটানোর আগে এগুলো সব মহড়া বলেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের অভিমত।
এক অফিসারের কথায়, ‘‘প্রতিটি ঘটনাই এমন ভাবে ঘটানো হয়েছে, যাতে আগুন ধরিয়ে নির্বিঘ্নে পালানো যায়। পালানোর পথ আগে থেকে তৈরি করে রেখেই আগুন লাগানো হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে কিছু ঘটনায় আর একটু ঝুঁকি নিলে কয়েক জন যাত্রীর প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল।’’
কিন্তু কোনও জঙ্গি সংগঠনকে সন্দেহ না-করে ওই সব ঘটনার সঙ্গে আইএসআইয়ের সরাসরি যুক্ত থাকার কথা বলা হচ্ছে কেন?
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের যুক্তি:
• কিছু তথ্যপ্রমাণ সে-দিকেই ইঙ্গিত করছে। যাতে মনে হচ্ছে, টাকা দিয়ে লোক নিয়োগ করে ট্রেনে আগুন লাগানো হয়েছে।
• আইএসআইয়ের মদতে পুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রায় সব ক’টিরই কোমর ভেঙে দেওয়া গিয়েছে বলে দাবি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের। তা ছাড়া ইয়াসিন ভটকল, তেহসিন আখতারের মতো বিস্ফোরণ ঘটাতে পারদর্শী জঙ্গিরা এখন জেলে। আইবি-র এক কর্তার কথায়, ‘‘একে তো সফল অপারেশন করার মতো কেউ নেই। সংগঠনগুলোও দুর্বল। এই পরিস্থিতিতেই ভাড়াটে লোকেদের দিয়ে অন্য রকম নাশকতার ছক করেছে আইএসআই।’’