Religious Politics

উন্নয়নের খামতি ঢাকছে যোগীর মেরুকরণ

আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যেও বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর সুবাদে রাজ্যে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু যে সব রাজ্যে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার চলছে, সেখানে কী হাল? উন্নয়ন, না কি শুধুই মেরুকরণ? তিন রাজ্য ঘুরে আনন্দবাজারের রিপোর্ট।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:১২
Share:

চলছে মহাকুম্ভ মেলা। উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের সঙ্গমে জনসমুদ্র। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।

‘‘দেখছেন তো, কেমন করে আমাদের ছাতির উপরে আস্ত একটি পুলিশ থানা তৈরি করা হচ্ছে? দিনরাত এক করে কাজ হচ্ছে তিনতলা থানার। মুখে শান্তিরক্ষার দাবি, কিন্তু এ হল স্থানীয় মুসলিমদের বার্তা দেওয়া, বাড়াবাড়ি করলেই মুশকিল। (প্র)শাসন সব নজর রাখছে।’’

Advertisement

একটানা কথা বলে থামলেন আসিফ মিঁয়া। আসিফের মতো স্থানীয় মুসলিমদের মনে এখন আশঙ্কা, অযোধ্যা-কাশীর পরে এ বার কি তবে সম্ভলের জামা মসজিদের (হিন্দুদের মতে যা হরিহর মন্দির) পালা! অন্য দিকে, যোগী আদিত্যনাথে প্রবল আস্থা রেখে সম্ভলের হিন্দু সমাজের একাংশ বলছে, হরিহর মন্দিরের পুনরুদ্ধারের সময় উপস্থিত। পারলে যোগীই পারবেন ওই অসাধ্যসাধন করতে। চলতি বিতর্কে বিভাজিত হিন্দু ও মুসলিম সমাজ। প্রভাব পড়েছে দৈনন্দিন জীবনে, ব্যবসা-বাণিজ্যেও। যদিও ধর্মের প্রাবল্য ফিকে করে দিয়েছে বাকি সব কিছু।

স্থানীয়দের মতে, বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কি কলিকালে জন্ম নেবেন সম্ভলে। হিন্দুদের দাবি, তাই না কি এখানকার হরিহর মন্দিরকে ভেঙে তার উপরে মসজিদ বানিয়েছিল বাবরের সেনাপতি মীর বেগ। সম্ভলের জামা মসজিদকে পাক দিয়ে তিনটি ঘিঞ্জি রাস্তাতেই ২৪ নভেম্বরের সংঘর্ষের (যাতে মারা যায় চার মুসলিম যুবক) পরে পুলিশ পাহারা বসেছে। ওয়াকফ সম্পত্তির দাবি অগ্রাহ্য করে মসজিদ লাগোয়া মাঠে উঠছে থানা। অভিযোগ উঠছে, যখন-তখন মুসলিম যুবকদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। পথে নামলে সাবিনা-ইউসুফদের দেখাতে হচ্ছে পরিচয়পত্র। প্রশাসনের চোখ রাঙানিতে যত সিঁটিয়ে গিয়েছে স্থানীয় মুসলিম সমাজ, তত সুর চড়াচ্ছে হিন্দুরা। সম্ভলে চল্লিশ বছর পরে বন্ধ মন্দিরের দরজা খুলেছে। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে শুরু হয়েছে অষ্টপ্রহর নামকীর্তন। সব মিলিয়ে যোগী আদিত্যনাথের নতুন গবেষণাগার সম্ভল আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে!

Advertisement

আদালতের আবেদনের দিনেই রায়দান, রায়দানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জামা মসজিদে সমীক্ষা শুরু হয়— তা থেকে স্থানীয় মুসলিম সমাজ মনে করছে, অযোধ্যা-কাশীর পরে যোগীর নজর এখন সম্ভলে। যার সফল প্রয়োগ সম্ভবত নতুন কোনও মন্দির-মসজিদ বিতর্ক, মেরুকরণের পথ খুলে দেবে। কারণ, এক উত্তরপ্রদেশেই মসজিদের নীচে মন্দিরের দাবি জানিয়ে অন্তত পঞ্চাশটি মামলা চলছে আদালতে। মেরুকরণের রাজনীতি প্রভাব ফেলেছে স্থানীয়দের ব্যবসায়। মুসলিম প্রধান সম্ভলে হিন্দুদের দোকানে যাওয়া বন্ধ করেছেন মুসলিমেরা। স্থানীয় বিজেপি নেতা সঞ্জয় কোলির ওষুধের দোকান রয়েছে মসজিদ সংলগ্ন বাজারে। তিনি বলেন, ‘‘মুসলিমরা দোকানে আসা কমিয়ে দিয়েছে। ব্যবসা মার খাচ্ছে। তবু মন্দিরের দাবি ছাড়ব না। শেষ দেখে ছাড়ব।’’ মন্দির-মসজিদ বিতর্কের মেঘে ফাটল ক্রমশ চওড়া হচ্ছে সম্ভলে।

সেই সময়ই পাশের আলিগড়ে কৃষক সমাজ জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে যোগী সরকারের উপরে। আলিগড়-আগরা করিডরের নামে যথেচ্ছ জমি কিনে চলেছে সরকার। কিন্তু দাম পাচ্ছেন না কৃষকেরা। উল্টে কম দামে কেনা জমি বেশি দামে বেসরকারি সংস্থাকে বিক্রি করে কোষাগার ভরছে সরকার, বলছেন স্থানীয়েরা। যাঁরা জমি বিক্রিতে রাজি নন, করিডরের ভিতরে থাকা সেই সব অনিচ্ছুকের জমি ঘিরে দেওয়া হচ্ছে চারিপাশ থেকে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো শীতের কুয়াশা মেখে পড়ে থাকা সেই জমি এখন আগাছার স্বর্গরাজ্য। জীর্ণ, শীর্ণ মালিকানাহীন গোমাতাদের চারণভূমি।

আলিগড় প্রতিরক্ষা করিডরে সবচেয়ে বেশি জমি গিয়েছে আন্ডালা গ্রামের। জলের দরে জমি বিক্রি করেছেন কৃষকেরা, বিঘা পিছু ৪-৬ লক্ষ টাকায়। জমি জাতীয় সড়কের ধারে হলে দাম কিছুটা বেশি মিলেছে। সেই জমি সরকার বিক্রি করেছে বিঘা প্রতি গড়ে ত্রিশ লাখ টাকায়। ফলে মার খেয়েছেন কৃষকেরা। আর উন্নয়ন? ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বছর একুশের দীপক। তাঁর কথায়, ‘‘উন্নয়ন সব তো করিডরে। সেখানে রাস্তা পাকা হয়েছে, পিচ পড়েছে, চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ, জল। আর করিডর লাগোয়া গ্রামে দিনের অধিকাংশ সময়ে বিদ্যুৎ নেই। রাস্তা ভাঙাচোরা। প্রতিরক্ষা করিডরে স্থানীয়দের জন্য হাসপাতাল গড়ার প্রতিশ্রুত রক্ষা হয়নি। ন্যূনতম চিকিৎসা করাতে হলে ছুটতে হয় আলিগড়ে। কথা ছিল জমিদাতাদের পরিবারপিছু এক জন সংস্থাগুলিতে চাকরি পাবেন। এক জনেরও পাহারাদারের চাকরি জোটেনি।’’ কি প্রতিরক্ষা করিডর, কি পরিবহণ নগর, যেখানেই জমি অধিগ্রহণ, সেখানেই কমবেশি এক গল্প।

এত অসন্তোষ সত্ত্বেও আলিগড়ে স্থানীয় সাংসদ-বিধায়ক উভয়েই বিজেপির। স্থানীয়দের মতে, ভোট মানে কেবল ধর্মের জিগির। হিন্দু-মুসলমান করে ভোট টানছে বিজেপি। বিরোধীদের দাবি, এক দিকে ধর্মের জুজু, অন্য দিকে অনুন্নয়নে সূচকে ক্রমশ নীচে নামছে উত্তরপ্রদেশ। আর্থিক দিক থেকে দেখলে, ব্যক্তিপিছু আয়ে শেষ থেকে দ্বিতীয় উত্তরপ্রদেশ (৭০,৭৯২ টাকা)। ২০২১-২২ সালের ওই পরিসংখ্যানে শেষে কেবল রয়েছে বিহার। ঋণ ও জিডিপি-র অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশ। ব্যক্তিপিছু ধারের পরিমাণ পৌঁছেছে প্রায় ৩১ হাজার টাকায়। অনুন্নয়নের উত্তরপ্রদেশে ধর্মই যোগীর হাতিয়ার বলে দাবি করেছিলেন সম্ভলের সমাজবাদী পার্টির নেতা আসলামউদ্দিন। স্থানীয় ওই এসপি নেতা বলেন, ‘‘আট বছর যোগী শাসন চলছে রাজ্যে। ডাবল ইঞ্জিনের সরকার হয়েও সামগ্রিক মানব উন্নয়ন সূচকে গোটা দেশে (২০২২) উত্তরপ্রদেশ শেষ থেকে তৃতীয়। নীচে কেবল বিহার আর ঝাড়খণ্ড।’’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘‘শিক্ষায় আমরা সবার শেষে। গড় আয়ুর প্রশ্নে সব শেষে আমাদের রাজ্য। খামতি সর্বত্র। আর তাই হিন্দু-মুসলিমদের খেপিয়ে দিয়ে সরকার ধরে রাখার কৌশল নিয়েছেন যোগী।’’

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement