‘থাপ্পড়’ ছবিতে তাপসী পান্নু।
থাপ্পড়!
ট্রেলারটি নিশ্চয়ই এত দিনে দেখে ফেলেছেন অনেকে। সিনেমার নামই ‘থাপ্পড়।’ ট্রেলারের প্রতিপাদ্য—একটি পার্টিতে সবার সামনে স্ত্রীকে চড় মারছেন স্বামী। পরবর্তীকালে স্ত্রী দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে ভাবছেন। সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, নিগ্রহ তিনি মানবেন না, সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবেন।
এর পরেই প্রশ্নটা উঠছে, শুধুমাত্র একটি থাপ্পড় কি বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে যথেষ্ট?
দু’বছর আগেকার ‘জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায়’ (এনএফএইচএস) দেখা গিয়েছে, ৩০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় মহিলা তাঁদের স্বামীর দ্বারা জীবনের কখনও না কখনও শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। সমীক্ষায় দাবি, ভারতের ৫৪.৮ শতাংশ (৪০-৪৯ বছর বয়সি) মহিলা মনে করেন, দাম্পত্য নিগ্রহের মধ্যে আপত্তির কিছু নেই। এই হিসেবটা ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের ক্ষেত্রে ৪৭.৭ শতাংশ।
বাস্তবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় একটি মেয়েকে? আদালতে তাঁর সিদ্ধান্ত কি গুরুত্ব পায়? আদালত পর্যন্ত বিতর্ক গড়ানোর আগে নিজের চেনা চৌহদ্দিতে কতটা সহযোগিতা পান কোনও স্ত্রী? এখনও ভারতীয় পরিবারে একটা চড় বিরাট ‘অপরাধ’ কি? বহু ক্ষেত্রেই ‘দাম্পত্যে অমন একটু-আধটু হয়ে থাকে’ বলে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শই দেওয়া হয় না কি? এই ‘একটু-আধটু’-র পরিমাপই বা কে ঠিক করে? কতটা হলে নিগ্রহ ‘একটু-আধটু’ নয়?
এই প্রশ্নগুলো নিয়ে যাঁদের প্রায়ই ওঠাবসা করতে হয়, সেই আইনি বিশেষজ্ঞদের এক জন সুদেষ্ণা বাগচী। তিনি জানালেন, ঘরে বা জনসমক্ষে কোনও স্ত্রীকে যদি চড় মারেন স্বামী, তা হলে সামাজিক অবস্থান ও সম্মানহানির গুরুত্ব বিচার করে তা মানসিক নির্যাতনের পর্যায়ে ফেলা যায়। হিন্দু বিবাহ সংক্রান্ত আইনে এর বিশদ ব্যাখ্যাও রয়েছে। তাঁর মতে, ‘‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যতই ভালবাসার সম্পর্ক থাকুক না কেন, চড় মারার কোনও অধিকার স্বামীর নেই। চড় যদি গুরুতর সম্মানহানির কারণ হয়, সে ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জানানো সম্ভব। তবে গোটা পরিস্থিতিটাই এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য, শুধু চড় নয়।’’ একই সঙ্গে সুদেষ্ণা মনে করাচ্ছেন, ‘‘আমাদের দেশে বিয়েকে একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয়। তাই আদালতেও সেই চেষ্টাটাই চলে, যাতে বোঝাপড়া করে বিষয়টা মিটিয়ে নেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে একটি চড়কে কোর্ট হয়তো বিক্ষিপ্ত ঘটনা বলে ভাবতে পারে। তবে তার ভিত্তিতে বিবাহবিচ্ছেদ হবে কি না, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে আদালতই। আর স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানও এখানে অবশ্যই বিবেচ্য।’’
রাজ্যের আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সদস্য-সচিব দুর্গা খৈতান মনে করালেন, ‘‘শুধু চড় নয়, বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক ভাবে মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে কি না, দেখা হবে সেটাও। আইন কিন্তু মহিলা বা পুরুষ, কারও প্রতি আলাদা করে সহমর্মিতা দেখাতে পারে না।’’ আর একটা জরুরি প্রসঙ্গ মাথায় রাখতে বলছেন দুর্গা। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা এখন মধ্যস্থতাকে (মিডিয়েশন) খুব গুরুত্ব দিচ্ছি। ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার বিষয়টিও নজরে রাখতে হবে। আত্মসম্মান নিয়ে যেমন কোনও আপস নয়, তেমনই দেখতে হবে পারিবারিক কাঠামো এবং সম্পর্কের প্রতি দায়বদ্ধতাকেও। ভয়ঙ্কর অপরাধেও তো এখন শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের কথা বলা হয়।’’ দুর্গার মতে, ‘‘পিতৃতন্ত্রের শিকার শুধু মেয়েরা নন। যে পুরুষ সর্বসমক্ষে স্ত্রীকে চড় মারেন, তিনিও এর শিকার। স্ত্রী যদি স্বামীকে অপমান করেন সেটাও সমান নিন্দনীয়। কারণ সকলেই সম্মানের অধিকারী।’’
নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত দোলন গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে অসম্মানজনক সম্পর্কে থাকা উচিত নয়। এখনও এ সমাজে মেয়েদের প্রতি বৈষম্য রয়েছে। তাই বিয়ে টিকিয়ে রাখতে ভাঙা সম্পর্কে পড়ে থাকা একেবারেই নারীবিদ্বেষী ভাবনা।’’
বৈবাহিক ধর্ষণকে এখনও এ দেশে ‘অপরাধের’ তালিকায় ফেলতে ঘাম ঝড়াতে হয়। সেখানে শুধু একটা থাপ্পড় কতটা গুরুত্ব পায়, সেটাই দেখার।