ঘিরে রেখেছেন মার্শালরা। ছবি পিটিআই।
সংসদের নিরাপত্তাকর্মী বা মার্শালরা রাজ্যসভা চেয়ারম্যানের আসন, সেক্রেটারি জেনারেলের চেয়ার ও রাজ্যসভার কর্মীদের টেবিল ঘিরে রেখেছেন। একেবারে দুর্গের প্রাচীরের মতো। পুরুষ ও মহিলা মার্শালদের সেই মানব-প্রাচীর ভেদ করে কোনও বিরোধী সাংসদ এগোতে পারছেন না। মার্শালদের সঙ্গে রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি চলছে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদদের। বিরোধীরা বিল, অন্যান্য কাগজপত্র ছিঁড়ে ওড়াচ্ছেন। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠছে। বিরোধীরা অভিযোগ তুলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদী সরকার গণতন্ত্রকে খুন করছে। সরকারি বিমা সংস্থাগুলিকে বন্ধু শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
এই সব কিছু অগ্রাহ্য করে, রাজ্যসভায় মার্শাল নামিয়ে আজ মোদী সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের বিল পাশ করাল। বুধবার সন্ধ্যায় সংসদে বিল পাশের কিছু ক্ষণ আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বণিকসভা সিআইআইয়ের বার্ষিক সভায় বলেন, ‘‘স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রেও বেসরকারি সংস্থাকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমানো হচ্ছে। এই সব কঠিন সিদ্ধান্ত সম্ভব হচ্ছে, কারণ দেশ শিল্পমহলের উপরে ভরসা করে।’’ সাধারণ বিমা ব্যবসা (জাতীয়করণ) আইনের সংশোধনী বিলে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থায় সরকারের হাতে বাধ্যতামূলক ভাবে অন্তত ৫১ শতাংশ মালিকানা রাখার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারি বিমা সংস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পথে আর কোনও বাধা থাকছে না।
কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে মঙ্গলবার কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, বাম সাংসদরা রাজ্যসভার কর্মীদের টেবিলে উঠে পড়েছিলেন। বিরোধীরা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের আসন তাক করে ফাইলও ছোড়েন। বিরোধীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিলেন, বুধবার বিমা বিল পাশের চেষ্টা হলে এর থেকেও বেশি গন্ডগোল হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরেই স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকার বিমা বেসরকারিকরণ বিল পাশ করাতে বদ্ধপরিকর। রাজ্যসভায় বিরোধীরা হট্টগোল শুরু করতেই, কিছু ক্ষণের জন্য সভা মুলতুবি করে মার্শাল নামানো হয়। তাঁরা বিরোধীদের আসনের সামনে দুর্গ তৈরি করে ফেলেন।
বিল পাশের পরে তৃণমূলের দোলা সেন, কংগ্রেসের ছায়া বর্মা অভিযোগ তুলেছেন, মার্শালরা তাঁদের ধাক্কা দিয়েছেন। বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে বলেন, ‘‘মহিলা সাংসদদের অপমান করা হয়েছে।’’ এনসিপি সভাপতি শরদ পওয়ার বলেন, ‘‘আমার ৫৫ বছরের সংসদীয় জীবনে এ ভাবে মহিলা সাংসদদের উপরে হামলা হতে দেখিনি। চল্লিশ জনের বেশি পুরুষ-মহিলা মার্শাল রাজ্যসভায় নামানো হয়েছিল। এই ঘটনা যন্ত্রণাদায়ক। এটা গণতন্ত্রের উপরে হামলা।’’ ঘটনার প্রতিবাদে বিরোধীরা ওয়াক-আউট করেন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন, বিরোধী সাংসদরাই মার্শালদের কলার ধরে টানাহেঁচড়া করেছেন। সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশীর অভিযোগ, ‘‘সংসদে মার্শালদের উপরে কোনও দিনও হামলা হয়নি। এটা সংসদের অপমান। দোষীদের কড়া শাস্তি হওয়া দরকার।’’
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বিমা ক্ষেত্রেও আন্দোলন চলছে। বিল প্রত্যাহারের পাশাপাশি বিরোধীদের দাবি ছিল, এই বিল আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক। ডিএমকে সাংসদ তিরুচি শিবা সেই প্রস্তাব আনলেও তা খারিজ হয়ে যায়। ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বিজু জনতা দল সাধারণত মোদী সরকারের পাশে থাকে। তারাও বিমা বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলেছিলেন। সরকার তাঁদের কথাতেও কান দেয়নি।
এর পরেও যে সরকার বেসরকারিকরণের নীতিতে অনড় থাকবে, তা বুঝিয়ে আজ প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, সরকার এই সব সংস্কার ‘বাধ্যবাধকতা’ থেকে নয়, নিজস্ব ‘বিশ্বাস’ থেকে করছে। মোদীর বক্তব্য, অতিমারির সময়েও সংস্কারের কাজ চলছে। কয়লা খনন, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, পরমাণু ক্ষেত্রও বেসরকারি সংস্থার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। আজ অর্থ মন্ত্রকের বিলগ্নিকরণ দফতরের সচিব তুহিন পাণ্ডে সিআইআই সভায় জানিয়েছেন, সরকার সরকারি সম্পত্তি বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে ৬ লক্ষ কোটি টাকা ঘরে তোলার পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের পরিকাঠামো, জাতীয় সড়ক। চলতি বছরেই এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম, শিপিং কর্পোরেশন, পবনহংস, বিইএমএল-এর মতো সংস্থার বিলগ্নিকরণ হবে। অর্থ বছরের শেষ পর্বে জীবন বিমা নিগম বা এলআইসি-র শেয়ারও বাজারে ছাড়া হবে।