সংসদ ভবন চত্বরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। পিটিআই।
যে কোনও জাদুকর সব সময়েই তাঁর সেরা খেলাটা শেষ বেলায় দেখানোর জন্য তুলে রাখেন। তেমনই পোড়খাওয়া রাজনীতিকরা তুরুপের তাস বার করেন ঠিক নির্বাচনের আগে।
আগামী বছর ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন। এ বছর তাই লোকসভা ভোটের আগে শেষ বছর। শুধু তাই নয়। এ বছরেই কর্নাটক, তেলঙ্গানা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানের মতো ন’টি রাজ্যে বিধানসভা ভোট। তার সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরে ভোট হলে এক্কেবারে দশ-দশটি নির্বাচনী পরীক্ষা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়ার দৌড় অব্যাহত রাখতে যে এ বারের বাজেটে ভোটারদের মন জয়ে নানা আতশবাজি সাজিয়ে রাখবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মধ্যবিত্তের জন্য কর ছাড়ে কিছুটা সুরাহা থাকতে পারে। চাষিদের জন্য পিএম-কিসান প্রকল্পে অনুদান ৬ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৮ হাজার টাকা হতে পারে। মহিলা, গরিব, অনগ্রসর, দলিত, জনজাতির ভোটারদের জন্যও চমক থাকতে পারে। গ্রামে একশো দিনের কাজের মতো শহরেও রোজগার গ্যারান্টি প্রকল্প চালু করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর যাত্রায় রাহুল গান্ধী যে ভাবে মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের মতো বাস্তব সমস্যা নিয়ে বার বার মোদী সরকারকে নিশানা করেছেন, তাতে মূল্যবৃদ্ধি-বেকারত্বের ক্ষতে প্রলেপ দিতে কিছু জনমোহিনী পদক্ষেপ দরকার বলে প্রধানমন্ত্রী মোদীর মনে হতেই পারে।
প্রশ্ন হল, নরেন্দ্র মোদী কি তাঁর হাতের সব তাস এখনই দেখিয়ে ফেলবেন? না কি কর্নাটক ভোটের জন্য আপাতত কিছু উপহার দিয়ে বাকি তাস লুকিয়ে রাখবেন? লোকসভা নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায় চলে এলে অন্য সব চমক ঘোষণা হবে?
ভোটাদাতাদের হাততালি কুড়োতে নরেন্দ্র মোদী তাঁর সেরা জাদুর খেলাটা চাইলে আরও পরে দেখাতে পারেন। কিন্তু বুধবার সকালে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যখন লোকসভায় বাজেট পেশ করবেন, তখন তাঁর সামনে অর্থনীতির দুই প্রধান চ্যালেঞ্জ হল, আর্থিক বৃদ্ধি ও মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য রেখে দু’দিকই সামাল দেওয়া।
কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা ঘনাচ্ছে। ধেয়ে আসছে মূল্যবৃদ্ধির ঝোড়ো হাওয়া। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রীকে বাজেটে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যথেষ্ট খরচ করতে হবে। যাতে কর্মসংস্থানও তৈরি হয়। কর্পোরেট কর এবং জিএসটি বাবদ আয় ভালই হচ্ছে। কিন্তু কোভিডের সময় এক দিকে সরকারের আয় কমে যাওয়া, অন্য দিকে খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে রাজকোষ ঘাটতি বেড়ে গিয়েছিল। অর্থনীতির মূল্যায়নকারী সংস্থা বা রেটিং এজেন্সিগুলির ভারত সম্পর্কে মূল্যায়ন যাতে খারাপের দিকে না গড়ায়, তার জন্য রাজকোষ ঘাটতিতে লাগাম পরাতেই হবে। তাই লোকসভা নির্বাচনের আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট হলেও খুব বেশি খয়রাতি করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদী নিজেই যখন খয়রাতির বিরুদ্ধে নীতিগত অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন।
নির্মলা সীতারামনের কপাল এমনই যে তিনি অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। এ বারও কোভিডের পরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ বেধেছে। চিনে কোভিড ভাইরাস নাছোরবান্দার মতো ফিরে ফিরে আসছে। আইএমএফ-এর পূর্বাভাস— ২০২৩-এ বিশ্ব অর্থনীতির আর্থিক বৃদ্ধির হার ২০২২-এর ৩.২% থেকে ২.৭%-এ নেমে আসবে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ, অর্ধেক ইউরোপ মন্দার কবলে পড়তে পারে। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে লড়তে উন্নত দেশগুলি সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে।
সেই তুলনায় ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার চলতি অর্থ বছরে ৭% ছুঁতে পারে। যা দেখে মনে হতেই পারে, ভারত বেশ ভাল অবস্থায় রয়েছে। বাস্তবে কোভিডের সময় জিডিপি এতটাই কমে গিয়েছিল যে সেই তুলনায় আর্থিক বৃদ্ধি অনেকটা বেশি দেখাচ্ছে। আর সেই সুবিধা মিলবে না। আগামী অর্থবর্ষেই বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের ঘরে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। স্বস্তির কথা হল, কারখানার উৎপাদন, পরিষেবার কিছুটা উন্নতি দেখা যাচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে শিল্প বা ব্যবসার জন্য ঋণ বিলিও বাড়ছে। অর্থ মন্ত্রকও মনে করছে, এ বার বেসরকারি লগ্নি আসবে। তাই অর্থমন্ত্রীকে সরকারি খরচের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার গোটা দায়িত্ব নিতে হবে না। আর্থিক বৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে চিনের পাশাপাশি ভারতেও কারখানা তৈরিতে আহ্বান জানাতে অর্থমন্ত্রীকে আরও উৎপাদন ভিত্তিক উৎসাহভাতা দিতে হবে। মোদী সরকার যে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে, বাজেটে তার প্রমাণ দেওয়াটাও জরুরি।
অর্থমন্ত্রীর সুবিধা হল, এ বছর তাঁর কর বাবদ আয় যথেষ্ট ভাল। আগামী বছরও একই রকম কর বাবদ আয় হবে বলে তিনি আশা করতে পারেন। খাদ্য ও সারে ভর্তুকিতেও খরচ কমানো যাবে। সুশাসনের পরিচয় দিতে একশো দিনের কাজ-এর মতো প্রকল্পে অর্থের অপচয়, বেনিয়ম বন্ধ করে তিনি অনেকখানি অর্থ সাশ্রয়ের আশা করতে পারেন। তবে চিন্তার কারণ হল, চলতি অর্থ বছরেই সরকারের রাজকোষ ঘাটতি ৬.৪ শতাংশ ছুঁচ্ছে। আগামী তিন বছরে ঘাটতি ৪.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পথ দেখাতে হবে বাজেটে।
এক কথায় বললে, ভোট ও অর্থনীতি, বাজেটে দুইয়ের মেলবন্ধন করাটাই নির্মলা সীতারামনের চ্যালেঞ্জ।