নির্মলা সীতারামন। ফাইল চিত্র।
দিন কয়েক আগেই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন দাবি করেছেন যে, তিনি নিজে মধ্যবিত্ত। তাই ‘মধ্যবিত্তদের চাপ বোঝেন’। এ কথা শোনার পর থেকেই স্বাভাবিক ভাবে বাজেটের মুখে মধ্যবিত্তদের একাংশের মনে আশা, এ বার বাজেটে আয়করে যদি কিছুটা সুরাহা মেলে।
সরকারি সূত্রের খবর, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট এবং এ বছরে ১০ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে মধ্যবিত্তের মন জয়ের লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের অন্দরমহলেও এ নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আয়করে সেই সুরাহা দিতে গেলে রাজকোষ সেই ‘ধাক্কা’ সামলাতে পারবে কি না কিংবা মূল্যবৃদ্ধির হার সদ্য খানিকটা মাথা নোয়ানোর পরে এতে উল্টো ফল হবে কি না, সেই হিসাবও কষতে হচ্ছে কেন্দ্রকে। কারণ, আয়করে ছাড় বাড়লে, আমজনতার হাতে বাড়তি নগদ টাকা আসবে। যা ফের ঠেলে তুলতে পারে মূল্যবৃদ্ধির হারকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, দু’দিকের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে সরাসরি করের হার কমিয়ে দেওয়া বা আয়করে ছাড়ের পরিমাণ বাড়ানোর বদলে মূলত তিন বছর আগে চালু হওয়া নতুন কর কাঠামোয় কিছু পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে। যাতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ওই নতুন কর কাঠামোয় নাম লেখাতে উৎসাহিত হন।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, সরকারের হাতে দু’টি বিকল্প রয়েছে—
প্রথম বিকল্প: পুরনো আয়কর কাঠামোয় কিছু রদবদল করা। এখন সেখানে আড়াই লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ৫% আয়কর দিতে হয়। পাঁচ লক্ষের বেশি আয়ে ২০% এবং দশ লক্ষ টাকার বেশি আয়ে ৩০% আয়কর গুনতে হয়। শেষ ধাপের উপরে নানা রকম সারচার্জ চাপার কারণে বেশি আয়ের ব্যক্তিদের কার্যত ৪০% পর্যন্ত আয়কর দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকার ৫%-এর পরেই সরাসরি ২০% এবং তার পরে ৩০% করের হারের বদলে মাঝখানে আর একটি করের হার চালু করতে পারে কি না, তা ভাবনা-চিন্তার পরিসরে রাখা। তাতে সামগ্রিক ভাবে আয়করের বোঝা কমবে।
দ্বিতীয় বিকল্প: তিন বছর আগে চালু হওয়া নতুন কর কাঠামোয় রদবদল করে তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা। ২০২০-র বাজেটে একটি নতুন কর কাঠামো চালু হয়েছিল। এখন কেউ চাইলে সেই আয়কর কাঠামো অনুযায়ীও কর দিতে পারেন। তাতে করের হার কমালেও, বিভিন্ন রকমের ছাড় তুলে দেওয়া হয়। ওই কাঠামোয় ৫ লক্ষ টাকা থেকে ৭.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে ১০%, ৭.৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা আয়ে ১৫%, ১০ থেকে ১২.৫ লক্ষ টাকা আয়ে ২০%, ১২.৫ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা আয়ে ২৫% এবং ১৫ লক্ষ টাকার বেশি আয়ে ৩০% আয়ের ব্যবস্থা চালু হয়। আয়করের হার কম হলেও সেখানে প্রভিডেন্ট ফান্ড, বাড়ির ঋণ, সন্তানের স্কুল ফি, জীবন বিমা, স্বাস্থ্য বিমা বাবদ কোনও ছাড় মেলে না। তাই খুব কম জনই নতুন কর কাঠামোয় নাম লিখিয়েছেন বলে সূত্রের খবর। এখন এই কর কাঠামোয় কিছু সুরাহা দেওয়া হতে পারে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে শিল্পমহল, বণিকসভা, কর বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, সরাসরি মানুষকে সুরাহা দিতে ৮০সি ধারায় কর ছাড়ের পরিমাণ ১.৫ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২.৫ লক্ষ টাকা করা, ৮০ডি ধারায় কর ছাড়ের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা, বিমায় পেনশনের অংশ করমুক্ত করা, বাড়ির ঋণে সুদে ছাড়ের পরিমাণ ২ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করার কথা সরকার ভাবতে পারে। তাতে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র লাভবান হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়েই এখন সরকারের শীর্ষ স্তরে আলোচনা চলছে।
কারণ, আয়করে ছাড় দেওয়ার উল্টো দিকটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারকে। আয়করে ছাড় মিললে, মানুষের হাতে বাড়তি নগদ আসবে। তাকে বাজারে কেনাকাটা বাড়বে। চাঙ্গা হতে পারে বৃদ্ধির হার। কিন্তু তেমনই তার সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির হারও বাড়তে পারে। এমনিতেই মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে মে মাস থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে সুদ বাড়াতে হয়েছে। এখন মূল্যবৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও, তাতে পুরোপুরি লাগাম পরানো যায়নি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, আয়করে ছাড় পেয়ে হাতে বাড়তি টাকা আসার পরে যদি তা জিনিসপত্রের চড়া দাম মেটাতে খরচ হয়ে যায়, তাতে হরেদরে মধ্যবিত্তের কিছু লাভ হবে না। উল্টে ফের দ্রুত মাথা তুলবে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি।
মোদী সরকার এর আগে কর্পোরেট কর কমালেও, আয়করের বোঝা কমায়নি বলে এমনিতেই ক্ষোভ রয়েছে। গত বছর বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্য আয়করে কোনও ছাড় না থাকায় অর্থমন্ত্রী নিজের মুখে দুঃখিতও (‘সরি’) বলেছিলেন। কিন্তু এ বার সেই দুঃখ ঘোচানোর চেষ্টা তিনি করবেন কি না, তার উত্তর দেবে বাজেটই।