সিন্ধুনদের জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে মতানৈক্য ছিলই। উরি-র সেনাঘাঁটিতে হামলার পর তা বড় আকার নিতে চলেছে। ১৯৬০ সালে করা এই চুক্তি দু’টি বড় যুদ্ধের ধকল সামলাতে পারলেও এখন প্রশ্ন উঠেছে, এ বার তা ভেঙে পড়বে না তো? এই চুক্তির ফলে পাকিস্তান চিরকালই বেশি লাভবান হয়েছে। পাকিস্তানের পুরো কৃষিব্যবস্থা এই চুক্তির উপর বিপুল ভাবে নির্ভরশীল। চরম কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে ভারত একে বাতিল করে দিতে পারে, এমন সম্ভাবনায় যথেষ্ট আতঙ্কে রয়েছে ইসলামাবাদ।
উরি-কাণ্ডের পর সামরিক পদক্ষেপ না করলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ভাবে চরম সক্রিয় নয়াদিল্লি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে পাশে টেনে পাকিস্তানকে একঘরে করার চেষ্টা অনেকটাই সফল। এখন পরিকল্পনা রয়েছে ২৬ সেপ্টেম্বর বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বক্তৃতায় পাকিস্তানকে সন্ত্রাস-প্রশ্নে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর। ইসলামাবাদকে ‘সবক শেখানোর’ জন্য আর কী কী পদক্ষেপ করা যায়, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে শীর্ষ পর্যায়ে। এই পরিস্থিতিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে সরব হয়েছেন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ। তাঁর কথায়, ‘‘আপনারা জানেন, সিন্ধুনদের জলচুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে দু’দেশের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এই সমস্যার সমাধান করার জন্য দ্বিপাক্ষিক সমন্বয় প্রয়োজন। কিন্তু একটা প্রাথমিক বিষয় আমি স্পষ্ট করে দিতে চাই, যে কোনও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার জন্য পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন।’’ এই চুক্তি বাতিল করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ ভারত করবে কিনা, তা জানতে চাওয়ায় একটু হেসে বিকাশ বলেছেন, ‘‘কূটনীতিতে সব কিছু মুখে বলে দেওয়া হয় না।’’
তাঁর এই মন্তব্যর পরেই বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এটা ঘটনা যে আরএসএস তথা সংঘ পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই এ ব্যাপারে কট্টরপন্থী লাইন নিয়ে চলছে। তাদের পক্ষ থেকেও মোদী সরকারের উপর চাপ রয়েছে যে, ‘শত্রু রাষ্ট্র’কে বাড়তি জল দেওয়া বন্ধ হোক। জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে হওয়া এই চুক্তি অনুযায়ী ঝিলম, চন্দ্রভাগা, শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী এবং সিন্ধু নদের (প্রায় প্রত্যেকটির উৎপত্তিস্থল ভারতে) ৮০ শতাংশ জল পাকিস্তানকে দিতে সম্মত হয়েছিল ভারত। সে সময় কাশ্মীরের কথা মাথায় রেখেই ভারত এই ব্যবস্থায় রাজি হয়। সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে উদার জলবণ্টন চুক্তি হিসেবে পরিচিত হয়েছিল এটি। বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় হওয়া এই চুক্তি অনুযায়ী, শতদ্রু, বিপাশা এবং ইরাবতী এবং তাদের শাখা নদীগুলির উপর ভারতের পূর্ণ অধিকার। অর্থাৎ এই সব নদীতে পরিবহণ, সেচ, বিদ্যুৎ প্রকল্প গঠনের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে ভারতের। ঝিলম, চন্দ্রভাগা ও সিন্ধু এবং তাদের শাখা নদীগুলির উপর পাকিস্তানের একই ধরনের পূর্ণ অধিকার থাকবে।
এর পর দু’দেশই নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন কাশ্মীরের নদীগুলিতে বাঁধ ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। এই নদীগুলির উজানে অবস্থিত হওয়ার ভৌগোলিক সুবিধা নিয়ে ভারতই বেশি বাঁধ তৈরি করেছে। যা নিয়ে বারবার আপত্তি তুলেছে পাকিস্তান। এই অবস্থায় দু’দেশের পক্ষ থেকেই বারবার সিন্ধু জলপ্রবাহ চুক্তির নবীকরণ এবং সংশোধনের দাবি উঠেছে। ভারত চেয়েছে পাকিস্তানকে ৮০ শতাংশ জল না দিয়ে আরও বেশি জল নিজেদের ব্যবহারের জন্য রাখতে। অন্য দিকে পাকিস্তান চেয়েছে, ভারত যে ভাবে নদীগুলিতে বাঁধ দিচ্ছে, তা বন্ধ করুক। গত দশকে চন্দ্রভাগা নদীতে বাগলিহার বাঁধ নির্মানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যায় পাকিস্তান। কিন্তু সেখানে তাদের আপত্তি খারিজ হয়ে যায়। ঘটনা হল, পাকিস্তানের কৃষি ও সেচের জন্য সিন্ধুনদের জল অপরিহার্য। ভারত যদি চুক্তি ভেঙে ভারতের দিকের নদীগুলির উপর একের পর এক বাঁধ তৈরি করতে শুরু করে, তা হলে ভেঙে পড়বে পাকিস্তানের কৃষি ব্যবস্থা।
কূটনৈতিক মহলের একাংশের বক্তব্য, এই চুক্তি নিয়ে ইসলামাবাদকে চাপে রাখাটাই আপাতত নয়াদিল্লির উদ্দেশ্য। এখনই একে বাতিল করা ভারতের পক্ষে কিছুটা কঠিন। কারণ সে ক্ষেত্রে ভুল বার্তা যাবে। এই নদীগুলির ক্ষেত্রে ভারত যেমন উজানে অবস্থিত, তেমনই হিমালয়ের একাধিক নদীর ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ভাটিতে। যেমন ব্রহ্মপুত্র। এই নদীর ক্ষেত্রে চিনের অবস্থান উজানে। ব্রহ্মপুত্র নিয়ে চিনের সঙ্গে মতবিরোধের সময় ভারত বারবারই সিন্ধু জলচুক্তিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে ভাটিতে অবস্থিত রাষ্ট্রের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কথা আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার করেছে। ফলে এখন ভারতের পক্ষে সিন্ধুর জলচুক্তি রাতারাতি বাতিল করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, এই জলচুক্তি বাতিল হলে কাশ্মীরে জটিলতা বাড়বে বই কমবে না। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলেও প্রচার করতে শুরু করবে যে, ভারতের জন্য পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মানুষ জল পাচ্ছেন না। তৃতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জলবণ্টন চুক্তিতেও এর প্রভাব পড়বে।
তাই সিন্ধু নিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিলেও পাকিস্তানকে চোখ রাঙানোর একটা বড় অস্ত্র হিসেবে একে ব্যবহার করতে চাইছে নয়াদিল্লি।