দিল্লির শিব বিহারে দুই ভাই মহম্মদ সমর ও মহম্মদ ইরফান। ছবি: প্রেম সিংহ
শিব বিহার তিন মাথার মোড়ে ঘুরঘুর করছিল মহম্মদ সমর ও মহম্মদ ইরফান। দুই ভাই। ইরফানের গায়ে সাদা কুর্তা-পাজামা। ছোট্ট সমর তেরঙা টি-শার্ট ও তেরঙা টুপিতে সেজেছে।
স্বাধীনতা দিবসে স্কুলে পতাকা তোলা হবে? সমর মাথা নেড়ে ডিআরপি কনভেন্ট সেকেন্ডারি স্কুলের দিকে দেখিয়ে বলে, ‘‘গত বছর মারামারির সময় আমাদের স্কুলে আগুন ধরিয়ে দিল। পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া স্কুলটা নতুন করে সাজিয়েছে। এ বার তো দেশের ৭৫-তম স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু কোভিডের জন্য স্কুল বন্ধ। জানি না, পতাকা তোলার সময় লাড্ডু খাওয়াবে কি না!’’
উত্তর-পূর্ব দিল্লি। শিব বিহার তিন মাথার মোড়ের এক দিকে শিবপুরী। মূলত হিন্দুদের বাস। অন্য দিকে মুস্তাফাবাদ। মুসলিমদের সংখ্যাই বেশি। গত বছর উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে হিংসার সময় এই শিব বিহার তিন মাথার মোড়ের রাস্তা হয়ে উঠেছিল ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান বর্ডার’। এক দিক থেকে পাথর, গুলি ছুটলে অন্য দিক থেকে ছুটে গিয়েছিল অ্যাসিডের বোতল, পেট্রল-বোমা। সিএএ-বিরোধী আন্দোলন ও তার বিরুদ্ধে বিজেপি নেতাদের হুঁশিয়ারিকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ছ’দিনের হিংসায় উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ৫৩ জন নিহত হয়েছিলেন।
শিব বিহার মোড়ের মাথা থেকে মুস্তাফাবাদের রাস্তায় ঢুকলেই দুই স্কুল, রাজধানী পাবলিক স্কুল ও ডিআরপি কনভেন্ট স্কুল। রাজধানী স্কুলের মালিক ফয়সল ফারুখ। ডিআরপি কনভেন্টের মালিক ধর্মেশ শর্মা। ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষের সময় রাজধানী স্কুলের ছাদে লোহার গুলতি বসিয়ে পাথর ছোড়া হয়েছিল শিবপুরীর দিকে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ডিআরপি কনভেন্ট স্কুলে।
ডিআরপি কনভেন্টের ফাঁকা স্কুলে বসে ধর্মেশ বলেন, ‘‘আমার স্কুলে হিন্দু, মুসলিম, দুই বাড়ির ছেলেমেয়েরাই ভর্তি হয়। সবাইকে নিয়েই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস পালন হত। কিন্তু গত বছরের হিংসা মানুষের মনে অবিশ্বাস গেঁথে দিয়েছে।’’ বিশ্বাসের সঙ্গে টান পড়েছে রুটিরুজিতেও। ধর্মেশ বলেন, ‘‘ফেব্রুয়ারিতে এত লোকের দোকানপাট পুড়ে ছাই হয়ে গেল। তার পরেই কোভিডের জন্য লকডাউন। অনেকেই ফি দিতে পারছেন না। অনলাইনে ক্লাস চললেও ১০০ জনের মধ্যে ৬০ জন আসে। বাকিরা পড়াশোনা ছেড়ে দিল, না কি অন্য কোথাও চলে গেল, জানি না।’’
শিব বিহারের পাশে চমন পার্ক মহল্লার সামনে আকসা মসজিদ। মহম্মদ ওয়াসিল মসজিদ দেখাশোনা করেন। গত বছর হিংসার পরে চমন পার্কের মুসলিম মহল্লার সামনে দেড় মানুষ উঁচু লোহার গেট বসেছে। গেটের পাশেই তেরঙা বিক্রি হচ্ছে। ওয়াসিল বলেন, ‘‘বাইরে থেকে লোক এসে মসজিদে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেছিল। এখন সব শান্ত, স্বাভাবিক। কিন্তু আবার কবে খুনোখুনি লেগে যাবে, তার ভরসা নেই। তাই লোহার গেট বসানো হয়েছে।’’
শিবপুরীর সতীশ ছানেরিয়ার বাড়ির এক তলায় রেস্তরাঁ। হিংসা ছড়িয়ে পড়তেই পালিয়ে গিয়েছিলেন সতীশরা। দুষ্কৃতীরা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ছোট ছোট তেরঙা দিয়ে রেস্তরাঁ সাজাতে সাজাতে সতীশ বলেন, ‘‘সে দিন বাড়ি না ছাড়লে প্রাণটা চলে যেত। আমার কত মুসলিম বন্ধু রয়েছে। ওরা কিন্তু হামলা করেনি। বাইরে থেকে লোক আনা হয়েছিল।’’
হিন্দু প্রধান শিবপুরীতে যে সব মুসলিম থাকতেন, তাঁরা অনেকেই বাড়ি বেচে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। মুস্তাফাবাদেও অনেক হিন্দু পরিবার জলের দরে বাড়ি বেচে দিচ্ছে। সতীশ, ওয়াসিল দু’জনেই হিংসার জন্য ‘বাইরের লোক’ আর ‘রাজনীতির কারবারি’-দের দোষ দেন।
শিব বিহারের পুরনো বাসিন্দা প্রেম গিরির পরিবারের ডেকরেটর্সের ব্যবসা। তাঁর ফাঁকা জমিতে এলাকার গোটা পঞ্চাশেক গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। সব গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গিরি বলেন, ‘‘আমাদের রাজনীতির কারবারিরা মানুষের মনে বিষ ঢুকিয়ে দেন। শুধু হিন্দু আর মুসলিমের লড়াই। এই রেষারেষি করে কি পেট ভরবে?’’
শিবপুরীর অনেক বাড়ির ছাদেই তেরঙা উড়ছে। সতীশের রেস্তরাঁয় কলেজ পড়ুয়া ফিরোজ, বিষেণ, মুশকান, কুমকুমরা একসঙ্গে পিৎজ়া খেতে এসেছে। আকসা মসজিদের পাশে লোহার গেটে গেরুয়া, সাদা, সবুজ রং। আর চিপ্স কিনে বাড়ি ফেরা মহম্মদ সমরের তেরঙা টি-শার্টে লেখা, ‘আই লাভ মাই ইন্ডিয়া’।