India-China Dispute

চিনা পণ্যের নিষেধে ক্ষতি হবে ঠিকই, কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই আমাদের

চিনের ঔদ্ধত্যের জবাব হিসেবে অনেকে এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তবে কিছু আশঙ্কাও জেগে উঠছে অনেকের মনে।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২০ ১৫:৫৩
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গালওয়ান উপত্যকায় চৈনিক আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সম্প্রতি ভারত সরকার চিনের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেনের উপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই উনষাটটি চৈনিক অ্যাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিকাঠামো এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে চিনা বিনিয়োগকে সরকারি নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চিনা দ্রব্য বর্জন করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এক দিকে যেমন চিনের ঔদ্ধত্যের জবাব হিসেবে অনেকে এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছেন, তেমনই অন্য দিকে কিছু আশঙ্কাও স্বাভাবিক ভাবে জেগে উঠছে সাধারণ নাগরিকদের মনে। প্রশ্ন উঠছে, কতটা সুচিন্তিত আর কতটাই বা আবেগ-তাড়িত এই বয়কট? ভারতীয় অর্থনীতি কি এই বয়কটের ভার বহন করতে পারবে? চিনকে ভারতীয় অর্থনীতির মানচিত্র থেকে একেবারে বাদ দিয়ে ভারত মসৃণ ভাবে তার অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটাতে পারবে তো?

Advertisement

কিছু দিন ধরেই ভারতীয় অর্থনীতিতে চিনের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। বর্তমানে সমস্ত দেশের মধ্যে চিন থেকে আমাদের আমদানির মূল্য সব থেকে বেশি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া প্রকাশিত আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত তথ্য থেকে জানতে পারছি, ২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষে চিন থেকে আমরা ৭০.৩ বিলিয়ন (৭০৩০ কোটি) মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছি। তুলনায় আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, আমদানির মূল্য ৩৫.৫ বিলিয়ন (৩৫৫০ কোটি) মার্কিন ডলার, অর্থাৎ চৈনিক দ্রব্য আমদানির অর্ধেক।

চিন থেকে আমাদের আমদানির তালিকাটি দীর্ঘ। স্মার্টফোন, বৈদ্যুতিক ও টেলিকম সরঞ্জাম, গাড়ির যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে রাসায়নিক সার, ওষুধপত্র এবং ওষুধপত্র তৈরির উপাদান, এমনকি মেট্রোরেলের কোচ পর্যন্ত সব কিছুই এই তালিকায় আছে। স্মার্টফোনের বাজারে চিনেরাই মার্কেট লিডার, তাদের পণ্যের সম্মিলিত বিক্রি মোট বিক্রির ৭২ শতাংশ। ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ৬৬ শতাংশ উপাদান আমাদের চিন থেকে আমদানি করতে হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন: চিনের সেনা সরানো ৬২ সালের পুনরাবৃত্তি নয়তো! সতর্ক বাহিনী​

তা ছাড়া ভারতে চিনাদের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগেও বেড়ে চলেছে। চৈনিক পুঁজি সরাসরি ঢুকে পড়েছে ভারতের ধাতুজাত শিল্প, সৌরশক্তি, সাধারণ পরিকাঠামো, বিভিন্ন স্টার্ট-আপ ছাড়াও নানা রকমের পরিষেবা-ভিত্তিক ভোগ্যপণ্যে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বিগ-বাসকেট, বাইজু’স, ফ্লিপকার্ট, মেক মাই ট্রিপ, ওলা, সুইগি, জোম্যাটো সবেতেই কিছু কিছু চৈনিক পুঁজি রয়েছে। চিনা শিল্প দফতরের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষে ভারতে সরাসরি চৈনিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) মার্কিন ডলার। অতএব আশঙ্কা হতেই পারে, চিনা দ্রব্য রাতারাতি বয়কট করলে কিংবা দেশে চিনা বিনিয়োগ আসা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে আমরাই অসুবিধেয় পড়ে যাব।

চৈনিক জিনিসের প্রধানতম আকর্ষণ তার দাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপান যেমন চটকদার জিনিসপত্র তৈরি করত, ইউরোপ-আমেরিকার জিনিসের তুলনায় যা ছিল নিম্নমানের এবং কম টেকসই, কিন্তু দামেও অনেক কম, চিনারা এখন সেই জায়গাটা ধরে নিয়েছে। ফলে সীমিত আয়ের ভারতীয় ক্রেতার কাছে চিনা জিনিসের কদর আছে। এ ছাড়াও কিছু কিছু অপেক্ষাকৃত দামী ব্র্যান্ডের প্রযুক্তি বা যন্ত্রাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে তৈরি হলেও বিভিন্ন অংশগুলো জোড়া লাগিয়ে অন্তিম পণ্যটি প্রস্তুত হয় চিন দেশে। এর একটা বড় উদাহরণ অ্যাপল কম্পিউটার। অ্যাপল-এর বেশির ভাগ মডেলের ক্ষেত্রেই শেষ পর্যায়ের সংযুক্তিকরণের কাজটা চিন দেশেই সম্পন্ন হয়। এই রকম উদাহরণ আরও আছে। সব মিলিয়ে, চৈনিক পণ্য রাতারাতি বন্ধ করে দিলে, সন্দেহ নেই, ভারতীয় ভোক্তাদের সরাসরি কিছু ক্ষতিস্বীকার করতেই হবে।

সনাতন অর্থশাস্ত্রে ভোক্তারাই শেষ কথা। কোনও নীতির ফলে যদি ভোক্তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় তা হলে সনাতন অর্থশাস্ত্র বলবে নীতিটায় গলদ আছে। অর্থাৎ সনাতন অর্থশাস্ত্র রাতারাতি চৈনিক পণ্য বয়কটকে সমর্থন করবে না। এর সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা যোগ করা যেতে পারে। চৈনিক পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে, যে পাইকারি এবং খুচরো ব্যবসায়ীরা চৈনিক পণ্য কেনাবেচা করেন তাঁদের ব্যবসা মার খাবে। ফলে এই সব ক্ষেত্রে কম লোক নিয়োগ হবে। আবার বিক্রির পরিমাণের দিক থেকে দেখলে পৃথিবীর বাজারে ভারত ওষুধপত্রের তৃতীয় বৃহত্তম বিক্রেতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই ভারত গত বছর ১৪ বিলিয়ন (১৪০০ কোটি) মার্কিন ডলার মূল্যের ওষুধপত্র বিক্রি করেছে। কিন্তু এই ওষুধপত্রের রাসায়নিক উপাদানগুলো অনেকাংশই চিন থেকে আমদানি করতে হয়েছে। চিন থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে ভারতের এই রফতানিও মার খাবে।

এ সব সত্ত্বেও বলব, চিনের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেনের উপর খানিকটা লাগাম অবশ্যই পরানো দরকার। এর একাধিক কারণ। কারণগুলো আর্থ-রাজনৈতিক। ১৯৯৮-৯৯ আর্থিক বর্ষে ভারতের মোট আমদানির ২.৫৮ শতাংশ ছিল চিন থেকে এবং মোট ভারতীয় রফতানির ১.২৮ শতাংশের গন্তব্য ছিল চিন। তার পরের দশ বছরে চিন থেকে আমদানি এবং চিন দেশে রফতানি দু’টোরই মোটামুটি চারগুণ গুরুত্ব বৃদ্ধি হয়েছে। ২০০৮-০৯ আর্থিক বর্ষে চিন থেকে আমাদের আমদানি দাঁড়িয়েছে মোট আমদানির ১০.৫ শতাংশ, চিন দেশে রফতানির অনুপাত মোট রফতানির ৫ শতাংশ। কোনও দেশের সঙ্গে আমদানি এবং রফতানির গুরুত্ব যদি মোটামুটি সমান হারে বৃদ্ধি পায় তা হলে বলার কিছু থাকে না। অর্থাৎ ১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০০৮-০৯ এই দশ বছর চিনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক লেনদেনের বৃদ্ধিটা একটা ভারসাম্য মেনে ঠিক পথেই চলছিল। কিন্তু তার পরের দশ বছরে লেনদেনগুলো ক্রমশ একপেশে হয়ে গিয়েছে। চিনকে আমরা যত জিনিস বিক্রি করতে পারছি, তার থেকে ঢের বেশি জিনিস চিন আমাদের বিক্রি করছে। ফলে আরও দশ বছর পরে, ২০১৮-১৯-এ পৌঁছে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের মোট আমদানির ১৩.৭ শতাংশ চিন থেকে আসছে। কিন্তু চিন দেশে আমাদের রফতানি মোট রফতানির সেই ৫ শতাংশই রয়ে গেছে। অর্থাৎ গত দশ বছরে চিনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক লেনদেনের চেহারাটা আমূল বদলে গিয়েছে।

ভারতের চিন-নির্ভরতা যে বিপজ্জনক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে বেরোতেই হবে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। এই দোকান হায়দরাবাদের। ছবি: এএফপি।

আমদানি-রফতানির মধ্যে এই ভারসাম্যহীনতার ফলে চিনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই ক্রমবর্ধমান ঘাটতির মানে, চিনা কোম্পানিদের হাতে ভারতীয় টাকা জমে যাচ্ছে, যে টাকাটা ভারতীয় ক্রেতারা চৈনিক পণ্যের উপর খরচ করেছে। এই টাকার একটা অংশ ডলারে রূপান্তরিত করে চিনারা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু একটা বড় অংশ আমাদের দেশেই বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যে বিনিয়োগের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমরা আগেই দিয়েছি।

দেশে চৈনিক বিনিয়োগ বাড়লে আমাদের লাভ না ক্ষতি? আপাতদৃষ্টিতে লাভ, কারণ বিনিয়োগ বাড়লে আর্থিক লেনদেন বাড়ে, কর্মসংস্থান বাড়ে। কিন্তু একটু দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টি নিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এর একটা অত্যন্ত বিপজ্জনক দিক আছে। ভারতে চৈনিক বিনিয়োগ বাড়ার দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য হল, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত ক্ষেত্রগুলোতে চিনে অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই অনুপ্রবেশের ফলে ওই ক্ষেত্রগুলোতে চিনাদের কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণও বাড়ছে, যা আদৌ কাম্য নয়। যদি চিনের সঙ্গে আমাদের একটা সুসম্পর্কের ইতিহাস থাকত তা হলে তবু এই নিয়ন্ত্রণ খানিকটা মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সেটা যখন নেই, বরং তার উল্টোটা আছে, যখন ভারত-চিন সম্পর্কের ইতিহাসটা বস্তুতপক্ষে দীর্ঘ বৈরিতার ইতিহাস, তখন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে চিনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়তে দেওয়াটা মূর্খামি। অর্থাৎ চিনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক লেনদেনে একটা লাগাম পরাতেই হবে।

আরও পড়ুন: এ বার একগুচ্ছ চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে আমেরিকাও​

২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষের পরিসংখ্যান বলছে, ওই বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের রফতানি ছিল ৫৭ বিলিয়ন (৫৭০০ কোটি) মার্কিনি ডলার, আমদানি ৫৮ বিলিয়ন (৫৮০০ কোটি)। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের লেনদেনে একটা পরিষ্কার ভারসাম্য রয়েছে। ওই একই বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আমাদের আমদানি ছিল ৩৫.৫ বিলিয়ন (৩৫৫০ কোটি) এবং রফতানি ৫২.৪ বিলিয়ন (৫২৪০ কোটি) ডলার, মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করে আমরা লেনদেনে উদ্বৃত্ত রাখতে পারছি। তুলনায়, ২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষে চিনের সঙ্গে আমাদের আমদানি ৭০.৩ বিলিয়ন (৭০৩০ কোটি), রফতানি ১৬.৭ বিলিয়ন (১৬৭০ কোটি), বাণিজ্যিক ঘাটতি ৫৩.৬ বিলিয়ন (৫৩৬০ কোটি) ডলার। এই ঘাটতির উদ্বেগজনক তাৎপর্য নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। আমাদের উচিত আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যটাকে চিনের দিক থেকে সরিয়ে ধীরে ধীরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিমুখে নিয়ে যাওয়া। ভারতের চিন-নির্ভরতা যে বিপজ্জনক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে বেরোনোর এটাই উপায়। কাজটা অবশ্য সহজ নয়।

চিনের সঙ্গে বাণিজ্যে লাগাম পরানোর আর একটা সোজাসাপটা যুক্তি আছে। এই মুহূর্তে চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে প্রায় একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা জানি, যুদ্ধের সময় কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতেই হয়। না হলে প্রতিপক্ষকে বশে আনা যায় না। চৈনিক পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞার ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে, সেটাকে যুদ্ধকালীন অবশ্যম্ভাবী ক্ষতি হিসেবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতির অধ্যাপক)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement