India-China

চিনা আগ্রাসনের জবাবে বর্জনের ডাক সামলানো যাবে তো?

পরিসংখ্যানও বলছে, বয়কটের পথে হেঁটে ‘চিনের যাত্রাভঙ্গ’ করতে গেলে, নিজের নাক কাটার সম্ভাবনা ভারতেরই।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২০ ০৫:৫৫
Share:

পুড়ছে চিনা পণ্য। বুধবার বড়বাজারে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

সীমান্তে চিনা আগ্রাসনের জবাবে ওই দেশের পণ্য বয়কট করুন ভারতের সাধারণ মানুষ। বাণিজ্যের দরজায় খিল এঁটে শায়েস্তা করা হোক বেজিংকে। লাদাখে সংঘর্ষের পর থেকে এই দাবিতে সরব বহু জন। সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া। পুরোদস্তুর প্রচারে সঙ্ঘের শাখা স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। বর্জনের দাবিতে ৫০০-রও বেশি পণ্যের তালিকা প্রকাশ করেছে খুচরো ব্যবসায়ীদের সংগঠন সিএআইটি-ও। অথচ এ দিনই এক ই-কমার্স সংস্থায় স্বল্প সময়ের ছাড়ে (ফ্ল্যাশ সেল) মোবাইল বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল এক চিনা সংস্থা। সব বিক্রি হতে আধ ঘণ্টাও লাগেনি!

Advertisement

পরিসংখ্যানও বলছে, বয়কটের পথে হেঁটে ‘চিনের যাত্রাভঙ্গ’ করতে গেলে, নিজের নাক কাটার সম্ভাবনা ভারতেরই। চিনা পণ্যের বিকল্পের খোঁজ এবং বেজিংয়ের বাণিজ্যিক প্রত্যাঘাত হজম করার কলজে এই মুহূর্তে ভারতীয় অর্থনীতির কতখানি, সে বিষয়েও তেমন নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। দিল্লি স্কুল অব ইকনমিকসের অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতির কথায়, “মোদী সরকার যতই মেক ইন ইন্ডিয়ার কথা বলুক, পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট যে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চিনা পণ্যের আমদানি এ দেশে কমেনি। এর একটা বড় অংশ আবার রিয়্যাক্টর, বয়লারের মতো জটিল যন্ত্র, বিভিন্ন বৈদ্যুতিন পণ্য কিংবা তার যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। এ দেশের ওষুধ শিল্পও তার কাঁচামালের জন্য প্রবল ভাবে নির্ভরশীল চিনের উপরে।” তাঁর প্রশ্ন, এই সমস্ত পণ্য আসার পথে রাতারাতি দেওয়াল তুলে দিলে, দেশের উৎপাদন শিল্প সেই ধাক্কা সহ্য করতে পারবে তো? অন্য জায়গা থেকে বেশি দরে কাঁচামাল কিনতে হলে, তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে দেশে কম দামে পণ্য বিক্রি? কিংবা দরের গলাকাটা লড়াইয়ে জিতে বিশ্ব বাজারে কল্কে পাওয়া? বেজিংয়ের প্রত্যাঘাতে ভারতও চিনের বাজার হারালে, বাণিজ্যের সেই ক্ষতি কোথায় পুষিয়ে নেওয়া যাবে, স্পষ্ট নয় তা-ও।

এ কথা ঠিক যে, ভারত শেষমেশ সত্যিই চিনা পণ্যের সামনে প্রাচীর তুললে, তাতে বেজিংয়ের বাণিজ্য ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা। এ দেশের বিপুল লোভনীয় বাজার তারা সহজে হাতছাড়া করতেও চাইবে না। কিন্তু তেমনই এ-ও সত্যি যে, স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ কিংবা সঙ্ঘের ‘ডাকে সাড়া দিয়ে’ এই দেশ চিনা পণ্য বর্জনের পথে হাঁটলে, সম্ভবত তার খেসারত দিতে হবে ভারতীয় অর্থনীতিকেও। বিশেষত যখন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল কিংবা পিপিই কিটে পর্যন্ত তাদের উপরে নির্ভরতা পুরোপুরি ছাঁটাই করা যায়নি। বেদান্ত রিসোর্সেস লিমিটেডের এগ্‌জিকিউটিভ চেয়ারম্যান অনিল আগরওয়াল আবার টুইট করে জানান, ভারতের অধিকাংশ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চিনের তৈরি। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভেল তা তৈরি করতে পারে।

Advertisement

আরও পড়ুন: লাদাখে চিনা হামলার কথা বাকি বাহিনী প্রায় ছ’ঘণ্টা পরে জানতে পারে!

আরও পড়ুন: চিনের মেজাজ বুঝতেই ভুল? প্রশ্নে মোদী সরকার

চিন-নির্ভরতা

• ২০১৭ সালে মোট ৬৮৮০ কোটি ডলারের আমদানির মধ্যে ৩৮৯০ কোটি ডলারের শুধু যন্ত্রপাতি। ৯৬২ কোটি ডলারের রাসায়নিক। যার একটি বড় অংশ বিভিন্ন জীবনদায়ী ওষুধ তৈরির কাঁচামাল।
• আইফোন থেকে আলপিন— এ দেশে বহুল ব্যবহৃত অজস্র পণ্য হয় পুরোটাই চিনে তৈরি, কিংবা তার পেটে সেঁধিয়ে রয়েছে পড়শি মুলুকের কারখানায় তৈরি যন্ত্রাংশ।
• ২০% গাড়ি-যন্ত্রাংশ, মোবাইল-ল্যাপটপ-কম্পিউটার সমেত বিভিন্ন বৈদ্যুতিন পণ্যের প্রায় ৭০% যন্ত্রাংশ, টিভি-ফ্রিজের মতো ভোগ্যপণ্যের অন্তত ৪০% চিনের মাটিতে তৈরি।
• গত দু’তিন বছরে ভারতের প্রথম সারির বহু স্টার্ট-আপে বিপুল টাকা লগ্নি করেছে বিভিন্ন চিনা সংস্থা। উদাহরণ, ওলা, হাইক, বিগ বাস্কেট, বাইজু, ওয়ো, পেটিএম, স্ন্যাপডিল, জ়োম্যাটো ইত্যাদি।

তথ্যসূত্র: আইএমএফ, রাষ্ট্রপুঞ্জ, বেসরকারি সমীক্ষা

দিল্লি স্কুল অব ইকনমিকসের অধ্যাপক উদয় ভানু সিংহ বলেন, “ওষুধ তৈরির রাসায়নিক থেকে মোবাইল কিংবা তার যন্ত্রাংশ। ইস্পাত-বিদ্যুতের মতো ভারী শিল্পের বড় এবং জটিল যন্ত্র থেকে শুরু করে দীপাবলির আলো। বাজার ছেয়ে রয়েছে চিনা পণ্যে। এর মধ্যে কিছু ব্যবহার না-করলে, সমস্যা হবে না ঠিকই। কিন্তু সত্যিই কি সমস্ত পণ্য এখনই ব্যবহার না-করার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা? কোথায় একই দামে তার বিকল্পের খোঁজ? সম্পূর্ণ চিন-নির্ভরতা ছেঁটে ফেলে এখনই এ দেশের মাটিতে বিকল্প পণ্য তৈরি করা যাবে কতগুলি?” আজকের এই বিশ্বায়িত অর্থনীতির দুনিয়ায় উপযুক্ত প্রস্তুতি এবং পরিকাঠামো ছাড়া এত বড় পরিবর্তন করতে গেলে, ভারত আন্তর্জাতিক জোগান শৃঙ্খলের (গ্লোবাল সাপ্লাই চেন) বাইরে চলে যাবে বলেও তাঁর আশঙ্কা। অনেকের দাবি, চিনা পণ্য রুখে যে ‘স্বদেশি’র ডাক দেওয়া হচ্ছে, তা হয়তো শুনতে ভাল। কিন্তু তাতে আখেরে বেশি দামে খারাপ গুণমানের পণ্য কিনতে বাধ্য হবেন আমজনতা। পকেট ভরবে গুটিকয় শিল্পপতির। অন্তত ১৯৫০ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে আমদানি আটকানোকে পাখির চোখ করা সরকারি নীতির অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।

তেমনই অপর পক্ষ বলছেন, এ সব নেহাতই ‘কথার কথা’। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ক্ষণস্থায়ী জাতীয়তাবাদের জিগির।’ তাঁদের কটাক্ষ, চিনা মোবাইলেই চিনা পণ্য বয়কটের ডাক ‘টাইপ’ করছেন অনেকে। কয়েকটি খবরের চ্যানেলে এ বিষয়ে আলোচনার বিশেষ অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপনদাতা চিনা মোবাইল সংস্থা! এ নিয়ে তুমুল তর্কের সময়ে বাড়িতে বসে খাবার আর মাসকাবারির বরাত যাচ্ছে এমন দুই সংস্থায়, যেখানে মূল লগ্নি চিনা সংস্থারই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement