গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
মহাকাশে হানা দিয়ে উপগ্রহ ধ্বংস করল ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র। আর তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে কেন্দ্র করে আকাশ ছুঁল রাজনৈতিক চাপানউতোর। আচমকা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে যে ভাবে দেশজোড়া কৌতূহল তৈরি করলেন নরেন্দ্র মোদী এবং তার পরে যে ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন অ্যান্টি-স্যাটেলাইট মিসাইলের সফল প্রয়োগের কথা, তাতে রাজনৈতিক ফসল তোলার সুস্পষ্ট প্রয়াস দেখল বিরোধী শিবির। তীব্র আক্রমণ করল মোদীকে। আর সরকার তথা শাসক দলের তরফে দিনভর চলল দেশভক্তি চাগিয়ে রাখার চেষ্টা।
বুধবার উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বা অ্যান্টি-স্যাটেলাইট মিসাইলের সফল পরীক্ষা করেছে ভারত। এ-স্যাট নামের ওই ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে মহাকাশে ভাসমান একটি কৃত্রিম উপগ্রহকে ভারত এ দিন ধ্বংস করেছে। দেশের এই সাফল্যের কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করার জন্যই প্রধানমন্ত্রী মোদী এ দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সংক্ষিপ্ত ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেন, ‘‘ভারত আজ অন্তরীক্ষ মহাশক্তি হিসেবে নিজের নাম নথিবদ্ধ করিয়ে নিয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এত দিন আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের এই সক্ষমতা ছিল। এ বার ভারত হয়ে উঠল চতুর্থ দেশ, যারা এই সক্ষমতায় পৌঁছল। প্রত্যেক ভারতবাসীর জন্য এর চেয়ে গর্বের মুহূর্ত আর কিছু হতে পারে না।’’
মোদীর এই ঘোষণা তথা ভাষণের পরেই গোটা দেশে বিতর্ক তৈরি হয়। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, পাক ভূখণ্ডে বিমানহানার কৃতিত্ব যে ভাবে মোদী নিজের খাতায় নিতে চেয়েছিলেন, সে ভাবেই ডিআরডিও-র সাফল্যকেও মোদী নিজের সাফল্য বলে তুলে ধরতে উদগ্রীব— বিরোধী শিবির থেকে এমন নানা মন্তব্য শোনা যেতে শুরু করে। উল্টোদিকে সরকার তথা শাসক শিবির স্বাভাবিক ভাবেই দিনভর মোদীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে।
আরও পডু়ন: কী এই অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিসাইল? দেশের সুরক্ষায় কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ?
আরও পড়ুন: দুই বোনের পর আরও এক নাবালিকা, পাকিস্তানে ফের হিন্দু কিশোরীকে ধর্মান্তরণ!
কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, সে কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই এ দিন জানান টুইটারে। সকাল ১১টা ২৩ নাগাদ টুইট করেন তিনি। তাতে লেখেন যে, ‘‘১১টা ৪৫ থেকে ১২টার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে আপনাদের মাঝে আসব।’’ মোদীর এই টুইট প্রবল জল্পনার জন্ম দেয় দেশ জুড়ে। দাবানলের মতো ছড়ায় তাঁর টুইটটির খবর। ১১টা ৪৫-এর মধ্যেই টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখতে শুরু করে প্রায় গোটা দেশ। তবে মোদী ১২টার মধ্যে ভাষণ শুরু করেননি। সাড়ে ১২টার সামান্য আগে তিনি ভাষণ শুরু করেন। সংক্ষিপ্ত ভাষণে ভারতের এই ‘অভূতপূর্ব’ সাফল্যের কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে জানান।
দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ (ডিআরডিও) এই ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করেছে। ক্ষেপণাস্ত্রটি আঘাত হেনেছে যে উপগ্রহে, সেটিও ভারতীয় উপগ্রহ। লোয়ার অর্বিটে ভ্রাম্যমান উপগ্রহটির কার্যকাল আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। বুধবার সকালে এ-স্যাটের সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে সেই মেয়াদ ফুরনো উপগ্রহকে ধ্বংস করা এবং প্রতিরক্ষা তথা মহাকাশ কর্মসূচিতে নতুন মাইল ফলকে পৌঁছনোর কাজ একসঙ্গে সেরে ফেলল ভারত।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
মোদী নিজের ভাষণেই ডিআরডিও-কে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ‘‘সর্বাগ্রে আমি ডিআরডিও-র বিজ্ঞানীদের, গবেষকদের এবং অন্য সংশ্লিষ্ট কর্মীদের অনেক অনেক অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই অসাধারণ সাফল্য তাঁরাই এনেছেন। আজ আবার তাঁরা দেশের মান বাড়িয়েছেন। আমাদের বিজ্ঞানীদের জন্য আমরা গর্বিত।’’
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যে চিঁড়ে যে খুব একটা ভেজেনি, তা বিরোধী দলগুলির প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট। ডিআরডিও-কে মোদী যতই অভিনন্দন জানান, আচমকা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ডিআরডিও-র সাফল্যকে নিজে ঘোষণা করার মাধ্যমে মোদী আসলে এই সাফল্যের গায়ে নিজের সরকারের স্টিকার লাগাতে চেয়েছেন। অভিযোগ বিরোধীদের।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটারে লেখেন, ‘‘গবেষণা, মহাকাশ ব্যবস্থাপনা এবং নির্মাণ হল একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া, যা বছরের পর বছর ধরে চলে। মোদী যথারীতি সব কিছুর কৃতিত্ব নিজে নিতে চান। কৃতিত্ব তাঁদের, যাঁরা প্রকৃতই এর দাবিদার, আমাদের বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা।’’
যে অভিযান নিয়ে এত কথা, তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মিশন শক্তি’। ক্ষেপণাস্ত্রটির উৎক্ষেপণের মুহূর্ত থেকে মহাকাশে ভাসমান উপগ্রহটি ধ্বংস হওয়া— গোটা প্রক্রিয়ায় সময় লেগেছে তিন মিনিট। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘মিশন শক্তি অত্যন্ত কঠিন অভিযান ছিল, যাতে খুবই উচ্চমানের প্রকৌশলগত সক্ষমতা জরুরি ছিল। বিজ্ঞানীরা সব নির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছেন।’’
ডিআরডিও যে যাবতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পেরেছে, তা নিয়ে বিরোধী দলগুলি কোনও সংশয় প্রকাশ করেনি। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধীর টুইটারে লেখেন, ‘‘খুব ভাল কাজ ডিআরডিও, আপনাদের কাজে অত্যন্ত গর্বিত।’’ কিন্তু তাতেই রাহুল থামেননি। তাঁর সংযোজন, ‘‘আমি প্রধানমন্ত্রীকেও শুভেচ্ছা জানাতে চাইব বিশ্ব থিয়েটার দিবসের।’’
ডিআরডিও-র সাফল্যের ঘোষণাটা করলেন প্রধানমন্ত্রী। আর দেশের মূল বিরোধী দলের সভাপতি সে সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানালেন ডিআরডিও-কে। প্রধানমন্ত্রীকেও তিনি শুভেচ্ছা জানালেন, কিন্তু সেটা বিশ্ব থিয়েটার দিবসের। এর মধ্যে যে মারাত্মক শ্লেষটা রয়েছে, সেটাকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি দেশের রাজনৈতিক শিবিরের।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্রমণ অবশ্য আরও তীব্র। মোদী রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলতে চেয়েছেন এবং নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে এই রকম ভাষণ দিয়ে মোদী আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমাদের বিজ্ঞানীদের নিয়ে আমরা সব সময়ই গর্বিত।’’ তার পাশাপাশিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণকে ‘সীমাহীন নাটক এবং প্রচারমুখীনতা’ বলে আক্রমণ করেছেন। নির্বাচনের সময় এই ভাষণ দিয়ে মোদী ‘বেপরোয়া ভাবে রাজনৈতিক ফসল তুলতে চাইছেন’ বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। লম্বা টুইটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত— এই মুহূর্তে এই পরীক্ষাটি করতেই হবে এবং যে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে, সেই সরকারকেই এই ঘোষণাটা করতে হবে, এমনটা মোটেই জরুরি ছিল না। আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানানো হচ্ছে বলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটারে জানিয়েছেন।
বিএসপি সুপ্রিমো মায়াবতীর সুরও মিলে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর টুইট, ‘‘মহাকাশে উপগ্রহ ধ্বংসের সফল পরীক্ষা করে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা যে ভাবে দেশের মাথা উঁচু করেছেন, তার জন্য অভিনন্দন। কিন্তু তার আড়ালে রাজনৈতিক লাভ করার যে চেষ্টা মোদী করছেন, তা অতি নিন্দনীয়।’’ আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে টুইটারেই নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মায়া।
প্রতিরক্ষা তথা মহাকাশ ক্ষেত্রে ভারতের এই সাফল্য আন্তর্জাতিক মহলকে যাতে ভুল বার্তা না দেয়, সে বিষয়ে নয়াদিল্লি যত্নবান ছিল। মোদী নিজের ভাষণে বলেন, ‘‘আমি আন্তর্জাতিক মহলকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমাদের এই সক্ষমতা অন্য কারও বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য নয়, এটা পুরোপুরি দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ।’’ মোদী আরও বলেন, ‘‘আমরা মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে। এই পরীক্ষা কোনও আন্তর্জাতিক আইন বা চুক্তিকে লঙ্ঘন করছে না।’’
মোদীর ভাষণ শেষ হতেই আন্তর্জাতিক মহলকে বার্তা দেয় ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকও। উপগ্রহ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ যে শুধুমাত্র ভারতের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্যই করা হল, সে কথা জোর দিয়ে বলা হয় বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে। রাত পর্যন্ত পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনও দেশের তরফ থেকে নেতিবাচক মন্তব্য আসেনি ভারতের এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ প্রসঙ্গে। কিন্তু দেশের মাটিতে মোদী তীব্র বিতর্কের মুখে পড়েছেন। বিরোধী দলগুলি প্রায় এক সুরে বিঁধেছে প্রধানমন্ত্রীকে।