মেয়ে ও পোষ্যের সঙ্গে নয়নমণি শইকিয়া। নিজস্ব চিত্র
নিজের সেরাটা দেশকে দিতে চাই। মেয়েকেও। চাকরি রয়েছে। আছে সংসার। এই যে এত পিছুটান-—তারাই তো আমার এগিয়ে চলার জেদ।
যে জেদের ফলেই অবশেষে চতুর্থ বার মিলল সাফল্য। মিলল কমনওয়েলথ সোনা। মিলল খ্যাতিও। স্বাধীনতার ৭৫ বছরেই।
ছিলাম ভারোত্তোলক, পিঠের ব্যথায় ২০০৮ সালে বদলে গেল সব। গুয়াহাটি সাইয়ের ডিরেক্টর সুভাষ বসুমাতারি, প্রশিক্ষক দেবকুমার বরা আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন সরুসজাই স্টেডিয়ামে। বিদেশি কোচ রিচার্ড গেল তখন সেখানে লন বলের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সেই আমার হাতেখড়ি।
২০১১ সালে রাঁচীতে ন্যাশনাল গেমসে জোড়া সোনা। ২০১৫ সালের কালিকট ন্যাশনাল গেমসে আরও দু’টো। ২০১৭ সালে দিল্লির এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও সোনার পদক। কিন্তু না আমায় কেউ চিনল, না আমার খেলাকে।
বুঝতে পারছিলাম, আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশকে সোনা এনে দিতেই হবে। কিন্তু ২০১০ সালে ভারত, ২০১৪ সালে গ্লাসগো, ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ গেমস। বারবার হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছে।
অবশ্য খেলাটা সোনার জন্য যতটা, আমার নিজের জন্য তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ছোট থেকে খেলাই ধ্যানজ্ঞান, ভালবাসা। ছোটবেলার বন্ধু ভাস্কর যে আমায় বিয়ে করতে চাইছে, সেই খবরটাও পেয়েছিলাম জাতীয় শিবিরে বসেই। ওঁর মা নিজেও অ্যাথলিট ছিলেন। ২০১৩ সালে, আমায় ঘরের বৌ করার প্রস্তাব নিয়ে তিনিই বাড়িতে আসেন। আমার মা ফোন করে মতামত জানতে চেয়েছিলেন। ভাস্করকে তো চিনতামই। হবু শাশুড়ির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, খেলা চালাতে পারব কি না? শাশুড়ি বললেন, “আমরাও চাই, তুমি খেলা চালিয়ে যাও।” সেই কথায় ভরসা করেই বিয়ে। সেই ভরসাতেই ৯ মাসের মেয়েকে রেখে চলে যেতে পেরেছিলাম জাতীয় শিবিরে। সেই বারেও সোনা নিয়ে ফিরেছিলাম।
সেই ছোট্ট তনয়া এখন সাত বছরের। কিন্তু বন দফতরের চাকরির জন্য প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ শনিবারই শুধু ঘরে ফিরতে পারি। শিবির থাকলে তা-ও নয়। মেয়েটাকে যেন শুধু ভিডিয়ো কলেই বড় হতে দেখলাম। আমি সোনা জেতার পরে সবাই যখন হাসছিল, তনয়া হাউ-হাউ করে কাঁদছে। সেই কথা জানতে পেরে কোন মায়ের মন ভাল থাকে?
মনে হচ্ছিল, একছুটে মেয়ের কাছে চলে যাই। মেডেলটা পরিয়ে দিই ওর গলায়।
অবশেষে ঘরে ফিরলাম, স্বাধীনতা দিবসের আগেই। মেয়েটার গলায় পরিয়ে দিলাম মেডেলটা।
এ বারের স্বাধীনতা দিবস সত্যিই আলাদা। ২০১০ থেকে ২০২২— এক ডজন বছর পার করে শেষ পর্যন্ত দেশকে কমনওয়েলথ সোনা দিতে পেরেছি। তাই এ বারের তেরঙা আমার কাছে আরও গর্বের, আরও রঙিন।
পরিবার যেমন পাশে ছিল, অফিসে সহকর্মীরাও তেমন দরকার পড়লেই আমার কাজের ভার হাসিমুখে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বিদেশে বসেই খবর পেয়েছিলাম, প্রমোশন হয়েছে। সবই কেমন আলো-আলো হয়ে রয়েছে, তাই না?
আমার ছোট জায়গা সরুপাথারের তস্য ছোট গ্রাম টেঙাবাড়ির নামও তো আলোয় এসেছে। হয়তো এই প্রথম বার। যেমন লাভলিনা অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পাওয়ার পরে তাঁর গ্রাম বারোমুখিয়া বা হিমা দাস ‘ধিং এক্সপ্রেস’ হয়ে ওঠার পরে কান্ধুলিমারির কথা সকলে জানতে পেরেছিল। ওদের জন্য আশপাশের উন্নতি হয়েছে বলে শুনেছি। আমার তেমন কোনও দাবি নেই, তবু আশা রাখি, আমার গ্রামেরও কিছু উন্নতি হবে, তৈরি হবে খেলার মাঠ, প্রশিক্ষণকেন্দ্র।
এখন কয়েক দিনের জন্য উৎসব। তারপর ফের কাজ আর ট্রেনিংয়ের রোজনামচা। মেয়েটাকেআরও বেশি সময় দিতে পারলে ভাল হত। আজ হয়তো দেশের কাছে আমি সোনার মেয়ে। সোনার মায়ের মেডেলটাও মেয়ের হাত থেকে পরতে চাই যে।
অনুলিখন: রাজীবাক্ষ রক্ষিত