দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ভিটেহারা হতে হয়েছিল হাজারও পরিবারকে প্রতীকী ছবি।
দেশ স্বাধীন হল। দেশভাগ হল। পুরনো দিল্লির বহু মুসলিম পরিবার পাকিস্তানের দিকে পা বাড়ালেন। গলি কাবাবিয়াঁর আবদুল্লা কুরেশি ভিটে ছাড়তে পারলেন না। কী ভাবে ছাড়বেন! এই গলি যে তাঁর বাবা ছোটে কাবাবির নামে। আবদুল্লা রয়ে গেলেন। তাঁর ছেলে আব্দুল জামা মসজিদের কাছে উর্দু বাজারে নতুন কাবাবের দোকান খুললেন। পঁচাত্তর বছর কেটে গিয়েছে। আব্দুল গনি কুরেশির পাঁচ ছেলে এখনও সেখানে কাবাব বিক্রি করছেন।
কুন্দনলাল গুজরাল পেশোয়ারের গোরা বাজারে নিজের রেস্তরাঁ চালাতেন। দেশভাগের পরে কুন্দনলাল স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে চলে এলেন দিল্লি। উদ্বাস্তু হিসেবে দরিয়াগঞ্জে জমি মেলায় নতুন করে রেস্তরাঁ খুললেন। তৈরি হল ‘বাটার চিকেন’ আবিষ্কারের রসায়নাগার। পশ্চিম পঞ্জাব থেকে আসা উদ্বাস্তুদের হাত ধরেই দিল্লিতে এল তন্দুরে রুটি সেঁকার সংস্কৃতি। দিল্লির ‘স্ট্রিট ফুড’-এ পাকাপাকি জায়গা করে নিল ছোলে ভাটুরে।
দেশভাগ মানে শুধুই শিক কাবাব, বাটার চিকেন, ছোলে ভাটুরের গল্প নয়। ১৯৪৭-এর অগস্টে পশ্চিম পঞ্জাব থেকে হাজারে হাজারে উদ্বাস্তু হিন্দু, শিখরা দিল্লিতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পালিয়ে আসার আগে তাঁদের উপরে যে অত্যাচার চলেছিল, সেই কাহিনি শুনে, তার রাগ গিয়ে পড়েছিল পুরনো দিল্লি, চাঁদনি চক, করোল বাগ, পাহাড়গঞ্জ, দরিয়াগঞ্জের নিরীহ মুসলিমদের উপরে। প্রাণ বাঁচাতে ঘরছাড়া মুসলিমরা মৌলানা আব্দুল কালাম আজাদ, রফি আহমেদ কিদোয়াই, আনিস কিদোয়াইয়ের বাড়িতে মাথা গুঁজেছিলেন। সেখানে আর কত জনের ঠাঁই হয়! হুমায়ুনের সমাধি, পুরনো কেল্লার চত্বরে শিবির খোলা হয়েছিল। হিংসা তবু থামেনি। করোল বাগের হাই স্কুলে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে বসা মুসলিম পড়ুয়াদের টেনে বের করে এনে খুন করা হয়েছিল। কনট প্লেসে মুসলিমদের উপরে হামলা দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ওডিওন সিনেমা হলের সামনে নীরব দর্শক পুলিশের ব্যাটন কেড়ে নিজেই তেড়ে গিয়েছিলেন হামলাকারীদের দিকে।
গত বছরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, ১৪ অগস্টকে ‘দেশভাগের বিভীষিকা স্মরণ দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির আগের দিন, অর্থাৎ আজ প্রধানমন্ত্রী দেশভাগে প্রাণ হারানো সকলের প্রতি টুইট করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। ইতিহাসের এই করুণ অধ্যায়ে যাঁরা দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানিয়েছেন। রবিবার বিকেলে যন্তর মন্তর থেকে নীরব মিছিলে অংশ নিয়েছেন বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা। সংসদের লাইব্রেরি ভবন, বিজেপির সদর দফতরে দেশভাগের বিভীষিকা নিয়ে প্রদর্শনী চলেছে। এ দিন সন্ধ্যা থেকে দিল্লির ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট’-এও এ বিষয়ে প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রক সূত্রের খবর, এ বছর শীতেই অমৃতসরের পরে দিল্লির কাশ্মীরি গেটে শাহজাদা দারাশুকোর তৈরি সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো লাইব্রেরিতে ‘পার্টিশন মিউজিয়াম’ বা ‘দেশভাগ সংগ্রহশালা’ খুলতে চলেছে।
কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছে, নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি বিভাজনের ক্ষত মনে করিয়ে দিয়ে ধর্মীয় বিভাজন উস্কে দিতে চান। তাঁরা দেশভাগের পিছনে যুক্তিকে সঠিক প্রমাণিত করতে চান। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর আসল উদ্দেশ্য হল নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে দেশভাগের ইতিহাসকে কাজে লাগানো। ওই করুণ অধ্যায়কে হিংসা, বিদ্বেষ ছড়াতে অপব্যবহার করা উচিত নয়। বাস্তব হল, সাভরকর দ্বিজাতি তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। জিন্না তা এগিয়ে নিয়ে যান। আধুনিক যুগের সাভরকর-জিন্নারা দেশের বিভাজনের একই রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।’’ বিজেপি আজ একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে দেশভাগের সময়ে জওহরলাল নেহরুর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছে, ‘‘যাঁদের হাতে বিভাজনকারী শক্তি (ব্রিটিশ)-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্ব ছিল, তাঁরা সে সময় কোথায় ছিলেন?” জয়রামের প্রশ্ন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কি জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করবেন, যিনি শরৎচন্দ্র বসুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাংলার বিভাজনকে সমর্থন করেছিলেন?”
পঞ্জাবের কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারির বক্তব্য, গত ৭৫ বছর ধরে এ দেশে ২০ কোটির বেশি মুসলিম হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছেন। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে দেশভাগের বিভীষিকাময় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে মাটিতে পুঁতে না ফেলে, কেন তাতে সিলমোহর দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে? তিওয়ারি বলেন, “এ ভাবে চললে স্বাধীনতার শতবর্ষের আগে আগামী ২৫ বছর অমৃতের বদলে বিষ-কালে পরিণত হবে।’’