তিন মাস পূর্ণ হল কৃষক আন্দোলনের। বৃহস্পতিবার দিল্লি-হরিয়ানা সীমানায় টিকরিতে। নিজস্ব চিত্র
তিন মাস হয়ে গেল। ভিড় না কি কমে আসছে?
প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ জসবিন্দর সিংহ ট্র্যাক্টর-ট্রলি থেকে বেরিয়ে এলেন। পঞ্জাবের জসবিন্দরের ঠিকানা ভাটিন্ডা জেলা। গ্রামের নাম গোবিন্দপুরা। ‘‘গুরু গোবিন্দ সিংহ কী বলেছিলেন জানেন?’’ পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বৃদ্ধ জসবিন্দর নিজেই উত্তর দেন, ‘‘চিড়িয়ো সে বাজ লড়ায়ুঁ, সওয়া লাখ সে এক লড়ায়ুঁ, তভি গোবিন্দ সিংহ নাম কহায়ুঁ।’’
চড়াই পাখি দিয়েই বাজপাখির বিরুদ্ধে লড়াই হবে। সওয়া লক্ষের বিরুদ্ধে একজন লড়বে। তবেই তাঁর নাম গুরু গোবিন্দ সিংহ। অর্থ বুঝিয়ে জসবিন্দর বলেন, ‘‘পাঁচ জন গ্রামে ফিরে গেলে পাঁচ হাজার আসবেন। আমরা ২০২৪ পর্যন্ত বসে থাকব।’’
দিল্লি-হরিয়ানা সীমানার টিকরি। মাথার উপরে মেট্রো স্টেশন ‘টিকরি বর্ডার’। নীচে রোহতক-দিল্লি হাইওয়ে সত্যিই ‘বর্ডার’-এর চেহারা নিয়েছে। লোহার ব্যারিকেড, কংক্রিটের চাঙর, কাঁটাতার, খালি ট্রাক-বাস। সিআইএসএফ, সিআরপিএফ, র্যা ফ, দিল্লি ও হরিয়ানা পুলিশের পাহারা। রাস্তার দিয়ে হাঁটার পথও বন্ধ। মেট্রো স্টেশন থেকে ‘নিয়ন্ত্রণরেখা’ পেরিয়ে একশো মিটার দূরের কৃষকদের প্রতিবাদ মঞ্চে পৌঁছতে রাস্তার ধারের বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে গলিপথ ধরতে হচ্ছে।
২৬ নভেম্বর দিল্লি সীমানায় তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন কৃষকেরা। আজ তিন মাস পূর্ণ হল। কিন্তু সিংঘু-টিকরি-গাজিপুর এখনও অবিচল। ভিড় কমেছে ঠিকই। কিন্তু সে শুধুই পঞ্জাব-হরিয়ানায় চাষের জমিতে গম তোলার মরসুম এসে গিয়েছে বলে। আর শীতের পরে গরমের প্রস্তুতি নিতে।
মেট্রো লাইনের নীচে রাস্তা ধরে ১০-১৫ কিলোমিটার শুধুই ট্র্যাক্টর-ট্রলি, তাঁবু। টিকরি বর্ডার মেট্রো স্টেশনের নীচে প্রতিবাদের মঞ্চ। তার পর রোহতক বাইপাসে পড়লে ফের প্রতিবাদের মঞ্চ। বাইপাস ধরে মাইলের পর মাইল শুধুই ট্র্যাক্টর। খান দশেক ট্র্যাক্টর-ট্রলি ঘিরে এক একখানি ‘পিন্ড’ বা গ্রামের নাম। তার সঙ্গে ট্রলিতে মাথা গুঁজে থাকা এক একটি বড় পরিবার বা ‘কুনবা’-র নাম।
জসবিন্দরের গ্রামেরই বাসিন্দা গলবন্ত সিংহ বলেন, ‘‘আমরা দুই বুড়ো এখানে বসে রয়েছি। বাড়ির ছেলেপিলেরা চাষের কাজ করছে। গ্রামে গ্রামে কমিটি তৈরি হয়েছে। আমরা টিকরি, সিংঘুতে এসে বিক্ষোভে বসলে, গ্রামের অন্য লোকেরা ফসল কেটে ঘরে তুলে দেবে। এক পয়সাও নেবে না। ট্র্যাক্টরের ডিজেল খরচও না। প্রতিটি কুনবার অন্তত একজন বিক্ষোভে থাকবে। মোদী সরকার যদি ভাবে, আমরা ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাব, তা হলে ভুল ভেবেছে।’’
দু’দিন আগে টিকরির প্রতিবাদ মঞ্চের আশেপাশে পুলিশের নোটিস পড়েছে। পুলিশের হুঁশিয়ারি, জমায়েত তুলতে হবে। এই জমায়েত বেআইনি। বারনালা জেলার হরজিন্দর সিংহ হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘পুলিশে তো আমাদেরই ছেলেপিলে। উপরওয়ালার নির্দেশ। তাই নোটিস টাঙিয়েছে। ওরাও জানে, আমরা হঠব না। আমার মেয়ে-জামাই কানাডা থেকে এসে ঘুরে গিয়েছে। বলেছে, বাবা, তুমি পিছু হঠবে না। মেয়ের কথা শুনব, না মোদীর?’’
গরম পড়তে শুরু করেছে দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানায়। নভেম্বরে যখন কৃষকদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তখন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি ছিল। এখন তা ৩০ ডিগ্রি ছুঁয়েছে। শীত না হয় লেপ-কম্বল জড়িয়ে, আগুন জ্বালিয়ে কেটে গেল। চাঁদিফাটা রোদে কী ভাবে দিনের পর দিন বসে থাকবেন? হরজিন্দর পাশের তাঁবুর দিকে দেখান, ‘‘ফ্যান, কুলার, এসি, সব চলে এসেছে। রাস্তার মাঝখানে তাঁবু তৈরি হচ্ছে। আমরা গমের খেতে মাথায় রোদ নিয়ে বসে থাকি। এখানে মেট্রো লাইনের নীচে বসে থাকতে পারব না?’’
২৬ ফেব্রুয়ারি কৃষক আন্দোলনের তিন মাস পূর্তি উপলক্ষে সংযুক্ত কিসান মোর্চা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘যুব কিসান দিবস’ পালন হবে। সিংঘু-টিকরি-গাজিপুরে তরুণরাই প্রতিবাদের মঞ্চ সামলাবেন। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরকে ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কংগ্রেসের কৃষক সংগঠন। ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (উগ্রহণ)-এর ডাকে ২৭ ফেব্রুয়ারি ৫০ হাজার কৃষক পঞ্জাব-হরিয়ানা থেকে দিল্লির সীমানায় আসবেন। জলবিন্দর-গলবন্ত হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘মোদীজির মাথা থেকে কৃষকের উপকারের ভূত না বের হলে ২০২৪ পর্যন্তই বসে থাকতে হবে।’’