মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরে ফিনান্স ম্যানেজমেন্ট নিয়ে উচ্চশিক্ষা। হতেই পারতেন কোনও বহুজাতিকের সুচাকুরে। কিন্তু নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপের জীবন মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার পদে সদ্য নিযুক্ত হেমন্ত নগরালের একেবারেই না-পসন্দ।
মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর জেলার জেড পি স্কুলে তাঁর পড়াশোনা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। তার পর বাকি স্কুলজীবন কাটে নাগপুরের পটবর্ধন হাই স্কুলে। নাগপুরেরই বিশ্বেশ্বরায়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পূর্ণ করেন। ফিনান্স ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর করেন যমুনালাল বজাজ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ থেকে।
১৯৮৭ সালের ব্যাচের মহারাষ্ট্র ক্যাডারের এই আইপিএস অফিসার কর্মজীবনের শুরুতেই নজর কাড়েন। রাজপুরার এএসপি হিসেবে তাঁর দক্ষতা প্রশংসিত হয় মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা চন্দ্রপুরায়।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত নাগরালে ছিলেন শোলাপুরের ডিসিপি। শোলাপুর কমিশনারেট তৈরির পিছনে তিনিই ছিলেন মূল কাণ্ডারী। ১৯৯২ সালে বাবরিকাণ্ডের পরে শোলাপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
রত্নগিরি জেলার পুলিশ সুপার থাকার সময়ে এনরন তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। নয়ের দশকের শেষে তিনি সিবিআই আধিকারিক হিসেবেও কর্মদক্ষতার ছাপ রাখেন। পরবর্তীতে সিবিআই-এর ডিআইজি পদে তিনি কেতন পারেখ কাণ্ড, মাধোপুরা সমবায় ব্যাঙ্ক কাণ্ড, হর্ষদ মেহতা কাণ্ড-সহ একাধিক ঘটনায় তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেন।
অতীতে মুম্বই পুলিশের যুগ্ম কমিশনার নগরালে কিছু দিনের জন্য মুম্বই পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার পদেও ছিলেন। সে সময় ‘রাস্তা রোকো’ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে তাঁর ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল স্বরাষ্ট্র বিভাগে।
২০১৬ সালের মে থেকে ২০১৮-র জুলাই পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন নভি মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার পদে। সে সময় মরাঠা সংরক্ষণের দাবিতে হওয়া আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে তিনিই ছিলেন প্রধান। ২০১৮ সালের অক্টোবরে পদোন্নতির পরে তিনি ডিজি হন। মহারাষ্ট্র জুড়ে ফরেন্সিক সায়েন্স পরীক্ষাগারগুলোর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন নগরালে।
২৬/১১ মুম্বই হানার পরে তিনি আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। শহরের রাস্তায় পড়ে থাকা আরডিএক্স ভর্তি ব্যাগ তিনি সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নিরাপদ জায়গায়। তার পর খবর দিয়েছিলেন বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডে।
৪ জন পুলিশকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে তাজ হোটেল থেকে উদ্ধার করেছিলেন বেশ কেয়ক জন আহতকে। সিনিয়র অফিসার এবং দফতরের অন্যান্য কর্মীর সঙ্গে তাজ হোটেলের শপিং প্লাজায় আটকে পড়া কয়েকশো জনকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি।
দীর্ঘ আইপিএস জীবনে এ বার নগরালে আসীন মুম্বই পুলিশের কমিশনার পদে। পরমবীর সিংহের স্থলাভিষিক্ত হলেন তিনি। অম্বানী-কাণ্ডে মুম্বই পুলিশ অফিসার সচিন বাজের জড়িয়ে পড়ার ঘটনার মধ্যেই এই রদবদল। প্রায় ১৬ বছর সাসপেনশনে থাকা সচিনকে মুম্বই পুলিশে পুনর্বহাল করছিলেন এই পরমবীরই।
যদিও মুম্বইবাসীর একটি বড় অংশের অভিমত, অম্বানী-কাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক টানাপড়েনেরই মূল্য দিতে হল পরমবীরকে। তাঁকে হোমগার্ডের ডিজি পদে বদলি করা হয়েছে।
অ্যান্টিলার সামনে বিস্ফোরকে ঠাসা গাড়ি পাওয়ার ঘটনায় মুম্বই পুলিশের এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট সচিনকে গ্রেফতার করে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। এই ঘটনায় রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে মহারাষ্ট্র সরকার। কারণ এক সময় এই সচিনেরই প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল শিবসেনা।
অভিযোগ, পরমবীরের নির্দেশেই অম্বানীর বাড়ির সামনে বোমাতঙ্কের ঘটনা ‘সাজিয়েছিলেন’ সচিন। মুম্বই পুলিশের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে সেই বৈঠকেই পরমবীরকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে অনুমান।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মুকেশ অম্বানীর মুম্বইয়ের বাড়ি অ্যান্টিলার সামনে থেকে বিস্ফোরক ঠাসা একটি জলপাই রঙের গাড়ি উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে জানা যায়, জানা যায়, ওই গাড়িটি মনসুখ হিরানি নামের এক গাড়ি ব্যবসায়ীর। আর তাঁর ওই গাড়িটি কিছু দিন আগেও ব্যবহার করেছেন মামলার তদন্তকারী অফিসার সচিন। ইতিমধ্যে মনসুখের দেহ উদ্ধার হয় মুম্বইয়ের একটি জলাশয় থেকে।
সাম্প্রতিক এই ঘটনাপ্রবাহে মুম্বই পুলিশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ধারণা বিভিন্ন মহলে। নগরালের নিয়োগ সেই ক্ষত কতটা প্রশমিত করতে পারে, আগামী সময়ে এখন সেটাই দেখার।