সংসদে ঢুকছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সোমবার। ছবি: পিটিআই
প্রয়োজন নেই কোনও রেশন কার্ডের। লাগবে না কোনও নথিপত্র। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে আসা অ-মুসলিম শরণার্থীরা আবেদন করলেই পাবেন ভারতীয় নাগরিকত্ব।
আজ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) নিয়ে বিতর্কের শুরুতে অমিত শাহ মূলত বাংলার শরণার্থীদের আশ্বস্ত করে বললেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বলছি, রেশন কার্ড থাকুক না থাকুক, কোনও সমস্যা নেই। যে (অ-মুসলিম) শরণার্থীরা ভারতে শরণ নিয়েছেন তাঁরাই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।’’ পাল্টা বক্তব্যে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতি করছে বিজেপি। যার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলার মানুষকে। রেশন কার্ড বানাতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন রাজ্যবাসী।’’
প্রশ্ন হল, এত রাজ্য থাকতে কেন পশ্চিমবঙ্গের নাম নিলেন শাহ? কেনই বা তুললেন রেশন কার্ডের প্রসঙ্গ? রাজ্য বিজেপি বলছে, নাগরিকত্ব বিলের প্রভাব যে সব রাজ্যের উপর সবচেয়ে বেশি পড়তে চলেছে তার অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের বহু মানুষ ওই বিলটি পাশ হলে নাগরিকত্ব পাবেন। যার ফায়দা বিধানসভা ভোটে পাওয়ার আশা করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁদের অভিযোগ, সেই কারণেই এনআরসি এবং সিএবি নিয়ে ভুয়ো প্রচার শুরু করেছে তৃণমূল। যার প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে। তিনটি আসনই হারে বিজেপি। ভোট ব্যাঙ্কের সেই ধস ঠেকাতেই আজ বাংলার শরণার্থীদের উদ্দেশে আলাদা বার্তা দিতে মুখ খুলেছেন শাহ। এক দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আশ্বাস দিয়েছেন, রেশন কার্ড তো দূরস্থান, শরণার্থী অ-মুসলিমদের নাগরিকত্ব পেতে কোনও কাগজই দরকার হবে না। শুধু আবেদনই যথেষ্ট। অন্য দিকে রাজ্যের পাঁচ বিজেপি সাংসদ, দিলীপ ঘোষ, লকেট চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র খাঁ, রাজু বিস্তা ও শান্তনু ঠাকুর বিতর্কে যোগ দিয়ে তৃণমূল সরকারকে নিশানা করেছেন। তৃণমূল সাংসদদের লক্ষ্য করে শাহ প্রশ্ন তুলেছেন, আপনারা কি চান না যে বাঙালিরা নাগরিকত্ব পান?
আরও পড়ুন: অসাংবিধানিক! মানছেনই না শাহ
অসমে এনআরসি-তে কুড়ি লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়া এবং গোটা দেশে এনআরসি তৈরির ঘোষণায় প্রবল আতঙ্কের সৃষ্টি হয় পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। যার জেরে রাজ্যের ডিজিটাল রেশন কার্ডে নাম তোলার জন্য ব্লক অফিসগুলিতে ভিড় জমতে শুরু করে। কেন্দ্রের নীতির ফলে মানুষের হেনস্থা হচ্ছে বলে প্রচারে নেমেছে তৃণমূল। অভিষেক বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষকে হাঁটু গেড়ে পরিচয়ের জন্য ভিক্ষে করতে হচ্ছে। অসমে এনআরসির ফল দেখে মানুষ আতঙ্কিত। রেশন কার্ড বানানোর হিড়িক পড়েছে।’’ রেশন কার্ডের লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর পাঁচটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
বিজেপি-র দিলীপ ঘোষ পাল্টা বলেন, ‘‘ভোট ব্যাঙ্ক হারাবার ভয়ে এনআরসি রুখতে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এত দিন ওই লোকগুলিকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে ভাবেনি রাজ্যের শাসক দল।’’ যদিও তৃণমূলের দাবি, ইতিমধ্যে রাজ্য, কেন্দ্র ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে উদ্বাস্তু কলোনি তৈরি করে থাকা পরিবারগুলিকে জমির অধিকার দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন: মধ্যরাতে লোকসভায় নাগরিকত্ব বিল পাশ করালেন অমিত শাহ
লকেট এ দিন বলেন, ‘‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের জায়গায় এনআরসি নিয়ে আলোচনা করছেন তৃণমূল সাংসদেরা। আসলে ওই বিল পাশ হলে অনুপ্রবেশকারীদের সমর্থনে চলা সরকার পড়ে যাবে বলে ভয় পাচ্ছে তৃণমূল।’’ বিজেপির অভিযোগ, রেশন কার্ডের সঙ্গে এনআরসি এবং সিএবির সম্পর্ক রয়েছে বলে তৃণমূল প্রচার শুরু করায় অহেতুক হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে রাজ্যবাসীকে। রাজ্য বিজেপির পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানো হয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। তার পরেই আজ সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে বিলটি নিয়ে আলোচনার সময়ে রাজ্যের মানুষকে আলাদা ভাবে আশ্বস্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
শাহের কথায়, প্রতিবেশী তিন দেশ থেকে আসা অ-মুসলিম (হিন্দু, শিখ জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি, খ্রিস্টান) ছ’টি ধর্মের লোকের নাগরিকত্ব পাওয়ার ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। আইনি জটিলতা এড়াতে পাসপোর্ট অ্যাক্ট ও ফরেনার্স অ্যাক্ট-এ অবৈধ ভাবে বসবাসের প্রশ্নে যে ফৌজদারি বিধি রয়েছে তা-ও পরিবর্তন হয়েছে। শাহের কথায়, ‘‘রাজনৈতিক দল প্রচার চালিয়েছে, যাঁরা অবৈধ ভাবে রয়েছেন তাঁরা নাগরিকত্বের আবেদন জানালে প্রমাণ হয়ে যাবে যে, তাঁরা ভারতের নাগরিক নন। তাঁদের জেলে ভরা হবে। ওই প্রচার মিথ্যা।’’
শাহ বলেন, ‘‘যে দিন ভারতে এসেছেন সে দিন থেকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ভয় দেখালে ভয় পাবেন না।’’ তাঁর দাবি, নতুন আইনে অবৈধ ভাবে থাকার জন্য কারুর বিরুদ্ধে চালু মামলাও সেই ব্যক্তি নাগরিকত্ব পেলেই খারিজ হয়ে যাবে। যে শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অবৈধ ভাবে থাকার অপরাধে তদন্ত চলছে তাঁরাও আবেদন করতে পারবেন। এমনকি যে শরণার্থীরা অবৈধ ভাবে থাকার সময়কালে জমি-বাড়ি কিনেছেন, বা চাকরি করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে আশ্বাস দেন তিনি।