অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলেই মধ্যরাতে দাহ করা হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টে বলল উত্তরপ্রদেশ সরকার। —ফাইল চিত্র
হাথরসের ঘটনাকে ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ (ভেরি এক্সট্রাঅর্ডিনারি) বলে আখ্যা দিয়ে সুবিচারের আশ্বাস দিল সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের নজরদারিতে তদন্তের আর্জি জানিয়ে দায়ের হওয়া মামলার শুনানিতে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। মধ্যরাতে লাশ দাহ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে যোগীর প্রশাসন। অন্য দিকে হাথরসের নির্যাতিতার নাম সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেওয়ায় অভিনেত্রী স্বরা ভাস্কর-সহ কয়েক জনকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠিয়েছে জাতীয় মহিলা কমিশন। এর মধ্যেই আজ, মঙ্গলবার নির্যাতিতার বাড়িতে যান সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি-সহ বামেদের একটি প্রতিনিধি দল।
‘ভেরি এক্সট্রাঅর্ডিনারি, শকিং কেস’
সুপ্রিম কোর্টের কোনও অবসরপ্রাপ্ত অথবা কর্মরত বিচারপতির নজরদারিতে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হয়েছে একটি জনস্বার্থ মামলা। মঙ্গলবার সেই মামলা ওঠে প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের বেঞ্চে। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি মামলাকারীর উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি কি বিচার বা তদন্ত অন্যন্ত সরিয়ে নেওয়ার আর্জি জানাচ্ছেন? ঘটনা অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও মর্মান্তিক বলেই আমরা মামলা শুনছি।’’
নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস
১০০ জন মহিলা আইনজীবীর পক্ষ থেকে মামলায় সওয়াল করেন আইনজীবী কীর্তি সিংহ। সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে তদন্তের পক্ষে সওয়াল করেন তিনি। প্রধান বিচারপতি তাঁকে বলেন, ‘‘আমরা আপনার উদ্বেগ বুঝতে পারছি। কিন্তু সব পক্ষের মতামত শুনতে দিন।" নিরপেক্ষ ও বাধাহীন তদন্তের আশ্বাস দিয়ে বিচারপতি বোবদে বলেন, "হাথরসের সাক্ষীদের কী ভাবে নিরাপত্তা দেওয়া হবে, তা হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে। নির্যাতিতার পরিবার কোনও আইনজীবী নিযুক্ত করেছেন কি না, তা-ও হলফনামায় উল্লেখ করতে হবে।’’
হাইকোর্টে নয় কেন?
হাথরস কাণ্ডে ইতিমধ্যেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করেছে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট। ১৪ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশ পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের আদালতে তলব করা হয়েছে। এ দিন সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘ইলাহাবাদ হাইকোর্টে না গিয়ে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে মামলা কেন?" জবাবে মামলাকারীর পক্ষে আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ বলেন, মামলার তদন্ত করছে সিবিআই। তাঁরা চান, উত্তরপ্রদেশ সরকারের এক্তিয়ার বহির্ভূত কোনও জায়গায় মামলা সরানো হোক।
আরও পড়ুন: ‘ধাক্কা সহ্য করে নেব, রক্ষা করব দেশ’, যোগীর পুলিশকে বার্তা রাহুলের
পরিবারের নিরাপত্তার দাবি
হাথরসের নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। আরএসএস-এর এক প্রচারকের শাসানি ধরা পড়েছে ক্যামেরাতেও। সেই সব নজির তুলে ধরে নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার দাবি তুলে সওয়াল করেন ইন্দিরা জয়সিংহ। তাঁর দাবি, মামলায় তফসিলি জাতি ও জনজাতি আইন প্রয়োগ করা হোক এবং মামলা উত্তরপ্রদেশ থেকে সরিয়ে দিল্লিতে নিয়ে আসা হোক। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা ইন্দিরা জয়চসিংহর উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি জানেন না যে, ওই পরিবার সুরক্ষিত। দেওয়া হয়েছে পুলিশি নিরাপত্তা।"
মধ্যরাতে কেন দাহ?
২৯ সেপ্টেম্বর দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে হাথরসের নির্যাতিতার মৃত্যুর পর ওই রাতেই হাথরসে নিয়ে গিয়েও মৃতদেহ পরিবারের হাতে দেয়নি পুলিশ। মধ্যরাতে পুলিশ-প্রশাসনের তৎপরতায় ও তদারকিতে লাশ দাহ করে দেওয়া হয়। আদালতে এ দিন এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, এই আশঙ্কায় আগেভাগেই হলফনামায় তার ব্যাখ্য়া দিয়ে রাখল যোগীর প্রশাসন। হলফনামায় বলা হয়েছে, অস্বাভাবিক (এক্সট্রাঅর্ডিনারি) পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলেই জেলা প্রশাসনকেও অস্বাভাবিক বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল। মধ্যরাতে দাহ করা হয়েছিল নির্যাতিতার দেহ।
আরও পড়ুন: মণীশ খুনে এফআইআর টিটাগড়-ব্যারাকপুর পুরসভার বিদায়ী পুরপ্রধানদের বিরুদ্ধে
জাতিগত হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ
শুনানিতে যোগী সরকারের পক্ষ থেকে দায়ের করা হলফনামায় অভিযোগ আনা হয়েছে, জাতিগত হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন বিরোধীরা। উত্তরপ্রদেশ সরকারকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছেন। বলা হয়েছে, পরিকল্পিত ভাবে ও ইচ্ছাকৃত জাতিগত হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা চলছে।
নজরদারিতে তদন্ত বিচার্য
মূল মামলা ছিল দু’টি— আদালতের নজরদারিতে তদন্ত এবং মামলা দিল্লিতে সরানোর দাবি। আদালতের হস্তক্ষেপে কোনও আপত্তি করেননি সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। নিরপেক্ষ বিচারের আর্জি জানান ইন্দিরা জয়সিংহও। বিচারপিত বোবদে ফের ঘটনা মর্মান্তিক উল্লেখ করে জানান, আদালতের নজরদারিতে তদন্তের এক্তিয়ার নিয়ে তাঁরা আলোচনা করবেন।
নির্যাতিতার নাম প্রকাশ!
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকায় রয়েছে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন বা শ্লীলতাহানির মতো ঘটনায় নির্যাতিতার নাম প্রকাশ করতে পারবে না সংবাদমাধ্যম বা অন্য কেউ। ঘটনাচক্রে বলিউড অভিনেত্রী স্বরা ভাস্কর, বিজেপি নেতা অমিত মালব্য এবং কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ সোশ্যাল মিডিয়ায় হাথরসের নির্যাতিতার নাম করে টুইট করেন। পরে সেই টুইট মুছে দেওয়া হলেও সক্রিয় হয়েছে জাতীয় মহিলা কমিশন। তিন জনের কাছেই ব্যাখ্যা তলব করেছে কমিশন।
যোগীর হুঙ্কার
এর মধ্যেই হাথরস কাণ্ড নিয়ে এ দিন ফের মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা উত্তরপ্রদেশের উন্নয়ন চান না, তাঁরাই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য। দোষীদের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশ সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। আমরা সদর্থক মনোভাব নিয়েই এগোচ্ছি।’’
নীরব মোদী-সরব রাহুল
যোগী আদিত্যনাথ মুখ খুললেও নীরব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তা নিয়ে নানা মহল থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এ দিন রাহুল গাঁধীও মোদীর মৌনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, "সারা দেশ দেখছে, নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে কী রকম আচরণ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একটা কথাও বলছেন না।’’
নির্যাতিতার বাড়িতে বামেরা
বৃহস্পতিবার মাঝপথে যোগীর পুলিশ আটকে দিলেও রবিবার নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়ে কথা বলে এসেছেন রাহুল গাঁধী, প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা-সহ কংগ্রেস নেতারা। তৃণমূল সাংসদদের প্রতিনিধি দলকে আটকে দিয়েছিল যোগীর পুলিশ। সোমবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন ভীম আর্মি প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদও। মঙ্গলবার সেই প্রবণতায় শামিল বামেরাও। এ দিন হাথরসে নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিয়ে আসে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। বাড়িতে গিয়ে নির্যাতিতার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন হাথরসের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটও।
নির্যাতিতার বাড়িতে বাম প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া
মৌলবাদী যোগ
তবে মথুরাতেই আটকে দেওয়া হয়েছে মৌলবাদী সংগঠন পিপলস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিদের। একটি গাড়িতে দিল্লি থেকে হাথরস যাওয়ার সময় মথুরার কাছে তাঁদের আটকায় পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় সংগঠনের চার সদস্যকে। পাশাপাশি এই সংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রীয় আর্থিক তদন্তকারী সংস্থা ইডি-কে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ।