জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে মোদী। শনিবার কুয়ালা লামপুরে আসিয়ানের বাণিজ্য ও লগ্নি সম্মেলনে। ছবি: পিটিআই।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, ব্রিটেনের পরে এ বার কুয়ালা লামপুরের মাটিতেও অচ্ছে দিনের কথা শোনালেন নরেন্দ্র মোদী। বিদেশি লগ্নিকে পাখির চোখ করে বললেন গত দেড় বছরে ভারতীয় অর্থনীতির দিন বদলের গল্প। কিন্তু বিরোধী দল থেকে অর্থনীতিবিদ— খাস দেশের মাটিতেই অনেকের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রীর ওই দাবির সঙ্গে বাস্তবের মিল কই? কোথায় ছুটছে সংস্কারের ঘোড়া? ইতিউতি কিছু সুখবর বাদ দিলে অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরার তেমন লক্ষণই বা কোথায়?
মালয়েশিয়ার রাজধানীতে শনিবার আসিয়ান-এর মঞ্চে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাঁর সরকার কেন্দ্রে রাশ ধরার পরে হাল ফিরতে শুরু করেছে অর্থনীতির। এশিয়ার উত্থানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, এই দাবি করে বলেছেন, ‘‘১৮ মাস আগে আমরা ক্ষমতায় এসেছি। অর্থনীতি তখন চ্যালেঞ্জের মুখে। কিন্তু এখন উল্টো ছবি। এমনিই তা হয়নি। সরকারের সুচিন্তিত, সম্মিলিত নীতির জন্যই এই সাফল্য।’’
কিন্তু কংগ্রেস নেতা অজয় মাকেনের কটাক্ষ, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বিদেশে অর্থনীতির হাল ফেরার খবর শোনাচ্ছেন। মুশকিল হল, সেই খবর এখনও ভারতেই পৌঁছয়নি।’’ অর্থনীতিবিদ এবং শিল্পমহলের প্রতিনিধিদেরও প্রশ্ন, মসনদে বসার আগে সংস্কারের ঝোড়ো ইনিংস খেলার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মোদী। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হল কই?
জমি-বিল বিশ বাঁও জলে। তীরে এসেও তরী ভিড়ছে না জিএসটি-র। বিল পাশ তো ছাড়, সংসদ চালাতেই নাজেহাল হতে হচ্ছে মোদী সরকারকে। অর্থনীতির হাল ফেরাতে সব থেকে যা গুরুত্বপূর্ণ, শুকিয়ে যাচ্ছে সেই লগ্নির স্রোতই।
এ দিন মোদী বলেছেন, রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রেখেও সরকারি লগ্নি বাড়িয়েছেন তাঁরা। সেই দাবি খারিজ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন অর্থনীতিবিদ বলছেন, ‘‘আমাদের কিছু বলার দরকার নেই। শুধু রঘুরাম রাজনের কথা শুনলেই চলবে।’’ উল্লেখ্য, শুক্রবারই হংকংয়ে এক অনুষ্ঠানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রাজন বলেছেন, ‘‘বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার সব থেকে বড় কারণ শ্লথ লগ্নি। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ার লক্ষণ নেই। বরং তা কমেছে। পূর্ণ ক্ষমতার তুলনায় প্রায় ৩০% কম উৎপাদন হচ্ছে কল-কারখানায়। একই দশা সরকারি লগ্নিরও।’’ অর্থাৎ, বিনিয়োগের বটুয়া আলগা করতে এ দেশের কর্পোরেট মহল দ্বিধাগ্রস্ত। আর মোদী এবং অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি যতই সরকারি লগ্নি বাড়িয়ে বেসরকারি লগ্নির অভাব পূরণের আশ্বাস দিন, তা-ও হচ্ছে না।
তবে অন্য পক্ষ অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ওই একই মঞ্চে আশার কথাও বলেছেন রাজন। তাঁর মতে, ভারতে বিদেশি বিনিয়োগের অঙ্ক বৃদ্ধিই লগ্নি-সমস্যার সমাধান করতে পারে। কারণ, তাতে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়বে। ফলে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত হবে বেসরকারি সংস্থাগুলি। উল্লেখ্য, জানুয়ারি থেকে জুন— এই ছ’মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ভারতে বিদেশি লগ্নি বেড়েছে ৩০%। এই পক্ষের পাল্টা যুক্তি, দেশে-দেশে গিয়ে সেই বিদেশি বিনিয়োগ টানারই চেষ্টা করছেন মোদী। কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভিজবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে।
অর্থনীতির হাল ফেরার প্রমাণ দিতে গিয়ে এ দিন মূলত চারটি দাবি করেছেন মোদী— (১) বৃদ্ধির চাকায় গতি বাড়া। (২) মূল্যবৃদ্ধির হার কমা। (৩) বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। (৪) মনমোহন-জমানায় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠা চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রা লেনদেনের ঘাটতি নেমে আসা।
এই চার দাবির বিপক্ষেও যুক্তি উঠছে বিস্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ছিল ৭.১%। তা বড়াই করার মতো নয়। বরং আগের বছরের একই সময়ের ৭.৪ শতাংশের তুলনায় কম। মূল্যবৃদ্ধি কমেছে। কিন্তু তার পিছনে কেন্দ্রের থেকে বেশি কৃতিত্ব বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমার। বিদেশি মুদ্রার লেনদেনের ঘাটতিও কমেছে মূলত ওই একই কারণে। তার উপর রফতানি যে ভাবে কমছে, তাতে ওই ঘাটতি ফের মাথাচাড়া দিতে পারে। বিদেশি লগ্নি বেড়েছে। মোদী বড়াই করে বলেছেন, ‘‘আমরা এখন অন্যতম উন্মুক্ত অর্থনীতি।’’ কিন্তু জমি, কর ইত্যাদি সংক্রান্ত জটিলতা না-কাটলে, তা দিয়ে প্রকল্প গড়া হবে কী ভাবে, সেই প্রশ্ন থাকছেই। তা ছাড়া অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খাতায়-কলমে বিদেশি লগ্নি বাড়ছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা দিয়ে বিদেশি অংশীদারি বাড়ছে কোনও সংস্থায়। নতুন কল-কারখানা তৈরি হচ্ছে কই?
আর এ দেশের লগ্নিকারীরা যে এখনও বিনিয়োগ করতে পুরোদস্তুর আত্মবিশ্বাসী নন, তার প্রমাণ শিল্পের জন্য ব্যাঙ্কের ঋণ এখনও না-বাড়া। তেমন চাঙ্গা না হওয়া কারখানায় উৎপাদন। তাই সব মিলিয়ে মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র প্রচারের উপরেও প্রশ্নচিহ্ন ঝুলতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
এতদিন জেটলি বারবার বলেছেন, বৃদ্ধির হার দ্রুত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে চড়া সুদ। কিন্তু গত ঋণনীতিতে শীর্ষ ব্যাঙ্ক সুদের হার এক ধাক্কায় ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে দেওয়ার পরেও বেসরকারি লগ্নিতে জোয়ার আসেনি।
অনেকে বলছেন, সুদ কমেছে ঠিকই। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ টানার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে জমি-জট। জমি অধিগ্রহণ বিল সংসদে আটকে যাওয়ায়, আপাতত এই বিষয়ে নতুন আইন তৈরি হওয়া বিশ বাঁও জলে। ফলে শিল্পমহলও ধোঁয়াশায় যে,
প্রকল্প পরিকল্পনার পরে জমি না-পেলে,
টাকা তাঁরা ঢালবেন কোথায়? তার উপর আজ দীর্ঘ দিন ধরে আটকে আছে জিএসটি বিল। অনেকেই মনে করেন, তা পাশ হলে লগ্নির ঝাঁপি উপুড় করতে তৈরি হবে অনেক সংস্থাই। বিশেষত ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলি।
এই সব কিছুর উপর অসহিষ্ণুতা বিতর্কে সরকার বনাম বিরোধী শিবিরের সংঘাত চরমে উঠেছে। ফলে শিল্পমহলের আশঙ্কা, এ বার সংস্কারের বিলগুলিতে ঐকমত্য তৈরি করা আরও কঠিন হবে মোদী সরকারের পক্ষে। যে কারণে ধর্মের রাজনীতি ছেড়ে মোদী সরকারকে শুধু সংস্কারে মন দিতে বলছে তারা।
এ দিন মোদীর দাবি, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের মতো প্রতিষ্ঠান ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে আস্থাশীল। তারা বলছে, অন্যান্য বড় উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ভারতের অর্থনীতির স্বাস্থ্য ঢের ভাল। ভিত মজবুত। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, ‘‘হাওয়া বদলের খবর সীমানা পেরোতে সময় নেয়। তাই আমি আপনাদের নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছি।’’ অর্থাৎ, ডাকতে এসেছেন ভারতে লগ্নির জন্য।
গত কয়েক মাসে মোদী এবং জেটলি বারবার বলেছেন, চিনে মন্দার সুযোগে বরং আন্তর্জাতিক বাজার ধরার আরও ভাল সুযোগ তৈরি হবে ভারতের সামনে। কিন্তু এ দিন সেই প্রসঙ্গেও কিছুটা উল্টো গেয়েছেন রাজন। বলেছেন, চিনের অর্থনীতি ঢিমে হওয়ার ধাক্কা ভারতে লাগবেই।
অনেকে বলছেন, দিনের শেষে মোদীকে দেখিয়েছে সেই সিইও-র মতো, যাঁর সংস্থার বিক্রিবাটা এখনও তেমন ভাল নয়। কিন্তু সেখানে লগ্নি টানতে তিনি মরিয়া।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে উল্টো তেরঙা
ফের আন্তর্জাতিক মঞ্চে কলঙ্কের মুখোমুখি ভারত। তাও আবার খোদ প্রধানমন্ত্রীর সামনেই। শনিবার আসিয়ানের মঞ্চে উল্টো করে টাঙানো রইল ভারতের তেরঙা। আর সে দিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল না করে তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে হাসি মুখে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মেলালেন মোদী। আর সেই দৃশ্যের সাক্ষী রইল গোটা বিশ্ব। শনিবার আসিয়ানের মঞ্চে ভারতের জাতীয় পতাকা উল্টো করে টাঙানো হয়। ভুলবশত সবুজ অংশটি ছিল উপরের দিকে এবং গেরুয়া নীচে। পতাকা-বিভ্রাট চোখে পড়তেই যদিও সংশোধন করে নেওয়া হয় ভুল। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন আসিয়ান মঞ্চের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা।